উঠল বাই, ভুটান যাই। কিছুটা এভাবেই ডুয়ার্স থেকে ভুটানে হানা। কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা সফর। অল্প খরচেই বিদেশ ভ্রমণের রোমাঞ্চ। সেই অনুভূতি মেলে ধরলেন অন্তরা চৌধুরি।
খুব শখ করেই পাসপোর্ট করিয়েছিলাম। যদি কোনওদিন কাজে লাগে! কালাপানি পেরোব এমন আশা করিনি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে তো যেতেই পারি। অন্ততপক্ষে বাংলাদেশ। না। সেখানেও যাবার সৌভাগ্য এখনও অর্জন করিনি। তাই পাসপোর্ট যেমনকার তেমনই আছে। কোথাও কোনও ছাপ পড়েনি।
কিছুদিন হল বিদেশ থেকে ঘুরে এসে দেশের মাটিতে পা দিয়েছি। কিন্তু অত শখ করে বানানো পাসপোর্ট কোনও কাজেই লাগলো না।
এবার আসল কথায় আসি। আমার পতিদেবের প্রস্তাবে গিয়েছিলাম ভুটান। যদিও সেটা ছিল কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা বিদেশ সফর। আমরা সেবার গিয়েছিলাম ডুয়ার্সে। উঠেছিলাম রাজাভাতখাওয়ায়। শুনলাম, দেড় ঘন্টায় নাকি ভুটান পৌঁছনো যায়। যেতে–আসতে খরচ মাত্র একশো টাকা। এত কাছে এসে, এত সস্তায় বিদেশ ভ্রণের সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে!
খুব ভোরবেলায় লোকাল ট্রেন ধরে হাসিমারা। সেখান থেকে অটোয় চড়ে জয়গাঁ। এই জয়গাঁ হল সীমান্ত শহর। পায়ে হেঁটে ওপারে গেলেই ভুটান। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। দুই দেশের ঘুম ভাঙলেও শীতঘুমের আমেজ তখনও কাটেনি। যেখানে নামলাম সেখান থেকে তাকিয়ে দেখি অনেকটা ইন্ডিয়া গেটের মত দেখতে একটা গেট। এপারে ভারত ওপারে ভুটান। কী অদ্ভুত রোমাঞ্চ! এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়ার মতোই, এক দেশ থেকে নিঃশব্দে আরেক দেশে পৌঁছে গেলাম। যাই হোক, এদেশ থেকে ওদেশে যে ঢুকলাম কেউ একবার চেক করল না। পাসপোর্ট তো দূরের কথা। পতিদেবকে বললাম-এ কেমন দেশ! এত অনায়াসে আরেকটা দেশে ঢোকা যায়? হ্যাঁ, এভাবেই সারাদিন হাজার হাজার মানুষ এদেশ–ওদেশ করছে। সীমান্তে কখনও ভোটার কার্ড দেখে, কখনও দেখে না। তবে, সঙ্গে রাখা ভাল।
আমি এই প্রথম নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এলাম। সে কী আনন্দ! কী অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ সাতসকালে তাড়া করছে। সীমান্তের দুই পারে যেন দু’রকম ছবি। একদিকে জয়গাঁ এক ঘিঞ্জি শহর। অন্যদিকে ফুন্টশেলিং যেন ঝকঝকে–তকতকে। নিজের দেশের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, পরিচ্ছন্নতার নিরিখে ‘স্বচ্ছ ভারত’ যেন দশ গোল খাবে পুঁচকে ভুটানের কাছে। ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছি। চারিদিকে ভুটানি ভাস্কর্য, চোখ ফেরানোই যায় না। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব! এমন সময় দেখি আমার পতিদেব ছোট্ট এক লামার সঙ্গে খোশ মেজাজে গল্প জুড়ে দিয়েছে। মুহূর্তটা মুহূর্তের মধ্যে ক্যামেরা বন্দী করে ফেললাম। আমাদের গন্তব্য ফুন্টশেলিং এর এক বহু পুরনো বৌদ্ধ গুম্ফা। কিন্তু তার আগে দেশি পেটে বিদেশি খিদে পেয়ে গেছে। ছোট্ট অথচ সুন্দর একটা দোকানে ঢুকলাম। ভুটানী ম্যাগি আর মোমো সহযোগে আমাদের উপবাস ভঙ্গ হল। ম্যাগিটার সবই ভাল। কিন্তু কেমন যেন টক টক। তবে, সব মিলিয়ে বেশ ভালই।
আগেই বলেছি আমরা কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে গিয়েছিলাম। তাই ওখানের স্ট্যান্ড থেকে একটা গাড়িতে চলে গেলাম ফুণ্টশেলিং। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ক্রমশঃ ওপর দিকে উঠছি। সব পাহাড়ি জায়গার চরিত্র ও সৌন্দর্য বোধহয় একই। বেশিদূর যেতে হল না। তার আগেই সেই গুম্ফায় পৌঁছে গেলাম। চারপাশটা দেখে মন ভরে গেল। এত সুন্দর এত নির্জন একটা পাহাড়ি উপত্যকা। কোনও বাড়তি আড়ম্বর নেই। এমন একটা জায়গায় আসার কথা কতদিন ধরে যে মনের মধ্যে লালন করেছি। আসলে মানুষ যা চায় তাই পায়। শুধু সেই ভাবনাটার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়।
চারিদিকে লোকজন নেই বললেই চলে। শান্ত, স্নিগ্ধ নির্জন এক বৌদ্ধ মন্দির। চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ফুলে ফলে সৌন্দর্যে ভরে আছে জায়গাটা। মন্দির তখনও খোলেনি। এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল নানান বয়সী একদল লামা। কী প্রাণবন্ত! কাজ করছে, খেলছে, দুষ্টুমি করছে। একসঙ্গে সবাই বড় হচ্ছে। এখনকার বাচ্চাদের মত হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে জ্যাঠাগিরি করেনি। একটা লামা দেখি মুখের ভেতর এক অদ্ভুত শব্দ করছে। অথচ ঠোঁট বন্ধ। গারগেল করলে যেরকম আওয়াজ হয় অনেকটা সেরকম। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম- ইয়ে কেয়া কার রাহে হো? সে জানাল- ইয়ে পূজা হ্যায়। ওদের দেখতে বেশ মজা লাগছিল। সবচেয়ে ছোট ছেলেগুলোই বেশি মুরুব্বি। হাব ভাব চাল চলন দেখে মনে হচ্ছিল অতিশয় ডেঁপো ছোকরা।
ওপর থেকে নিচের শহরের জনবসতি দেখা যাচ্ছিল। আর ওই দূরে দেখা যায় শুকিয়ে যাওয়া নদী তোর্সা। আমরা ঘরতে ঘুরতে একটা গুলঞ্চ গাছের নীচে এসে বসে পড়লাম। চারিদিকে ফুলের সুগন্ধ। কী অদ্ভুত শান্তি! পবিত্র নীরবতা! পাখির কূজন! সব মিলিয়ে যেন স্বর্গরাজ্য। কত গাছ চারিদিকে। কেন জানি না ইচ্ছে করছিল প্রত্যেকটা গাছকে স্পর্শ করতে। তাদের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে। অখণ্ড নীরবতার সঙ্গে থাকতে থাকতে। হয়তো ওরাও কিছু বলতে চায়।
চোখে পড়ল ভুটানি জনৈক এক ভদ্রলোক রোদে বসে ফোনে কথা বলছে। আর তার পিঠে বেশ অদ্ভুত কায়দায় বাঁধা আছে তার শিশু সন্তান। কান্নাকাটির বালাই নেই। সেও অবাক বিস্ময়ে এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ পান করছে। ওই রকম একটা জায়গা থেকে আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আসতেই হবে। ফেরার পথে কুম্ভীর বিভ্রাট দেখতে গেলাম। টিকিট কেটে ঢুকে দেখি প্রচুর কুমীর রোদ্দুরে শুয়ে আছে। জ্যান্ত না মৃত দেখে বোঝার উপায় নেই। যেভাবে চিন্তাহীন হয়ে এরা দিন কাটাচ্ছে তাতে ওদের জীবনের কোনও উদ্দেশ্য বা বিধেয় আছে বলে তো মনে হল না। যে টিকিট কাটছে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- এরা জীবিত না মৃত? লোকটা কী জোর আমার ওপর খচে গেল। ভুটানি ভাষায় যে কী বলল কে জানে। বেরোতে যাব, এমন সময় দেখি টমেটো টাইপের একটা ভুটানি বাচ্ছা ছেলে। হাতে একটা পপকর্নের প্যাকেট। গাছ আর লোহার বেড়ার মাঝখানে খুব অল্প একটু জায়গা। তার মধ্য দিয়ে নিজের শরীরটাকে পার করার চেষ্টা করছে। আমরা দেখে খুব একচোট হাসলাম। ছবি তোলার পোজ দিতে বলায় সুন্দর দিয়ে দিল।
যাইহোক পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এলাম। এটা সেটার দোকান ঘুরতে ঘুরতে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে সব দোকানেই রাজা ও রানীর ছবি রয়েছে। এখানকার সব হোটেল, দোকান, রেস্তোরাঁয় রাজার ছবি রাখা নাকি বাধ্যতামূলক। ভূটানের মানুষ রাজাকে ভগবান জ্ঞানেই পূজা করে। তবে ওদের পোষাকগুলো বড়ই অদ্ভুত। বিশেষতঃ ছেলেদের। আমাদের এখানকার ওভারকোটের মতই। কিন্ত হাঁটুতে নামার অনেক আগেই তা ফুরিয়ে গেছে। ভাবছিলাম এই রকম পোষাক যদি আমার বাবা কাকারা পরে অফিস যায় তাহলে কীরকম লাগবে দেখতে। ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বেশ হাসি পাচ্ছিল।
ইচ্ছে ছিল সকলের জন্য বিদেশ ভ্রমনের কিছু স্মারক চিহ্ন নিয়ে আসব। কিন্তু দামের পারদ যেভাবে উর্দ্ধমুখী আমাদের পকেটের অবস্থা ততটাই নিম্নমুখী। তাই সকলের জন্য ভূটানী ম্যাগি, অন্ধকারে খেলে আলো জ্বলবে এমন চকলেট, আর গুটিকয়েক ভূটানি কোল্ডড্রিঙ্কস নিয়ে আবার আমার দেশে টুক করে ফিরে এলাম। শুধু আমার দেশের পরেই নয় সকল দেশের পরেই ঠেকাই মাথা। কাজেই ভিসা পাসপোর্ট না থাকলেও বিদেশ ভ্রমণের এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।