ছোট্ট স্টেশন, হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি

হয়ত সেখানে যাওয়ার কথাই ছিল না। ফাঁকা এক রেলস্টেশনে হঠাৎ করে নেমে পড়া। পাশ দিয়ে হয়ত বয়ে গেছে নদী। ছোট্ট চালা ঘরে হয়ত চপ–‌ঘুগনির দোকান। নাম না জানা ঠিকানায় আশ্চর্য এক ভ্রমণ। শরতের আলতো রোদে একটা দিন হারিয়ে যাওয়া। এমনই হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের কথা উঠে এল অন্তরা চৌধুরির লেখায়।

পুজোয় যদি এক ছুটে হারিয়ে যেতে পারতাম তো বেশ হত। অনেকটা গুপী বাঘার মতো। তবে এ হারিয়ে যাওয়া সে হারিয়ে যাওয়া নয়। দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হারিয়ে যাওয়া। বেড়াতে গেলেই আমাদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে। কিন্তু গন্তব্যহীন বেড়াতে যাওয়ার মজাই কিন্তু আলাদা।
বেশ কিছু রেলস্টেশন আছে, যেখানে ভুল না করলে কোন ট্রেন কখনই দাঁড়ায় না। ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট সেইসব স্টেশন। চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে এদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। খুব অল্প সময়ের দেখা। ক্ষণস্থায়ী। হাত নাড়ার আগেই সেই দেখা ফুরিয়ে যায়। মনে হয়, এখানে যদি একটু নামতে পারতাম, এর চারপাশটা ঘুরে দেখতে পারতাম, তো বেশ হত। এই নির্জন অখ্যাত জায়গার সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করতাম। খালি পায়ে সবুজ ঘাসের ওপর চলতে চলতে চোরকাঁটাদের সঙ্গে খেলা করতাম। ফড়িং-এর উড়ে যাওয়া দেখতাম। আর নাম না জানা জলাশয়ের পাশে গিয়ে তার কান্না শুনতাম।
কিন্তু সেই সুযোগ কখনই আসে না। হারিয়ে যেতে চাইলেও কেন যে হারিয়ে যেতে পারি না!

galudih
আমাদের শহুরে শিক্ষিত মানুষের ইগোর খোলসটা খুলে যে কোনও একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়াই যায়। মন যেখানে চাইবে সেখানে নেমে পড়লেই হল। পুজোর সময় একটা দিন নিছকই পাগলামি। একা একা ভাল না লাগলে মনের মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে ইচ্ছেডানায় ভর করে হারিয়ে যাওয়াই যায়। তবে মানুষটি নিতান্ত বেরসিক না হলে, আর কর্পোরেট না হলে এই পাগলামি তারও ভাল লাগতে বাধ্য। লোকাল ট্রেন সব স্টেশনেই মোটামুটি থামে। ছোটবেলায় খাওয়া মটর ভাজা, বা টিকটিকি চকলেট এই সমস্ত ট্রেনে পাওয়া যায়। দু এক প্যাকেট কিনে খেতে খেতে পছন্দসই যে কোনও একটা প্রত্যন্ত স্টেশনে নেমে পড়লেই হল। ট্রেন চলে যাবার পর দেখা গেল স্টেশন মাস্টারের ছোট্ট একটা ঘর। জরাজীর্ণ টিকিট কাউন্টার আর একটা ছোট্ট টিনের ছাউনি। ব্যাস। স্টেশন বলতে এটুকুই। আর দুপাশে সবুজ ধানখেত। তেলেনাপোতা আবিষ্কারের মত সেই প্রত্যন্ত জায়গাও একটু আবিষ্কারের অপেক্ষায়। মর্ত্যে যখন মা দুর্গা আসেন তখন প্রকৃতিতে এবং মানুষের মনে স্বাভাবিক ভাবেই আনন্দে ভরপুর থাকে। সেই আনন্দে গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ ধরে হেঁটে যাওয়াই যায়। কিছু উৎসুক গ্রাম্য বালক-বালিকা হাঁ করে শহুরে মানুষের আদিখ্যেতা দেখতেই পারে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের শহুরে খোলস তখন খুলে গেছে। নীল আকাশ, তুলোর মতো মেঘ, কটকটে সূর্যের আলো, নধরকান্তি ধানের খেতের অসম্ভব অহঙ্কার, কাশ ফুলের ব্রেক ড্যান্স আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজে আমরা তখন মুক্ত বিহঙ্গ।
অনেক দিন কোনও নদীর কাছে যাওয়া হয় না। কিন্তু সেই গ্রামে তো নদী নেই। ধানখেতের পাশে রয়েছে একটা ছোট্ট জোড়। আজ বাঁধন ছাড়া দিন। সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাবার দিন। তাই মিনারেল ওয়াটারের বোতল ফেলে দিয়ে সেই জোড়ের জল আকণ্ঠ পান করে চোখে মুখে ছিটিয়ে একটু শীতল হওয়াই যায়। ভয় নেই। কোনও একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন-মনের আনন্দে কোনও কিছু খেলে শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না।
আশে পাশে বড় গাছ না থাকলেই বা দুঃখ কী। অনেকগুলো বাবলা গাছ সম্মিলিতভাবে বেশ সুন্দর একটা ছায়ার জন্ম দিয়েছে। সেই ছায়ার কোলে গিয়ে একটু বসাই যায়। ব্যাগ থেকে কোনও ব্র্যান্ডেড বিস্কুট বার না করলেও চলবে। অনেক গ্রাম্য খাবারের স্বাদ নেওয়া বাকি। তার আগে একটু ছোটবেলায় ফিরে গেলে মন্দ হয় না।
ইটালিয়ান মারবেলের কল্যাণে অনেকদিন আমাদের অরিজিনাল মাটিতে পা পড়েনি। স্কুল জীবনে বাড়ি ফেরার পথে ইচ্ছে করে চোরকাঁটার জঙ্গলে পা দিয়ে হাঁটার অভ্যেস অনেকেরই ছিল। বাড়ি ফিরে সেই চোরকাঁটা ছাড়ানোর একটা আলদা রোমাঞ্চ ছিল। আবার এই ধেড়ে বয়সে খালি পায়ে একটু চোরকাঁটাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করলে কেমন লাগবে! চলতে চলতেই দেখা গেল ঘাসের ওপর কত ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই যে ছোটবেলায় ফড়িং ধরে সুতো বেঁধে আবার উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কত দুষ্টুমি লুকিয়ে আছে। সুতো না বাঁধলেও পুরনো অভ্যেস ঝালিয়ে নিতে কতক্ষণ! ফড়িং এর পেছন পেছন অকারণ দৌড়নোর মধ্যে বেশ মজা আছে।

rail station1
আমরা আমাদের ছোটবেলায় নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠেছি। এখনকার বাবা মায়েদের মত এত শাসন ছিল না। তাই প্রকৃতিকে নিজের মতন করে আমরা চিনেছিলাম, উপভোগ করেছিলাম। ঘাসের ভেতর যে কত্ত ছোট ছোট রঙ বেরঙ্গের ফুল হয় সেতো কেউ দেখিয়ে দেয়নি। সেই আবিষ্কার তো নিজেরাই করেছি। আইনস্টাইনের থেকে আমরা কম কীসে! কাজেই সেই নামগোত্রহীন ফুলকে কেউ পাত্তা না দিলেও আমাদের দিতে অসুবিধে কোথায়! তাই মনের মানুষটিকে নিয়ে আবার নতুন করে ঘাসের ছোট্ট ছোট্ট ফুল দেখার আনন্দে মেতে যাওয়াই যায়। একধরণের ঘাস আছে যার মধ্যে অনেকটা ক্যাপসুল সাইজের কিছুটা ট্যারাবেঁকা একটা বীজ হয়। শুকিয়ে যাবার পর সেটা ফাটালে তার মধ্যে বেশ একটা ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায়। আবার এই ঘাসের মধ্যেই জন্মায় আমরুল গাছ। খুব নিবিড় ভাবে না দেখলে চোখে পড়ার কথা নয়। এই পাতা নাকি পেট খারাপের অব্যর্থ ওষুধ। ছোট্ট ছোট্ট ঢ্যাঁড়সের মত দেখতে একরকম ফল হয়। খেতে বেশ টকটক লাগে। বিষ ফল নয়। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। নির্ভয়ে খাওয়া যায়। কেবল একটু আদিম সরলতায় ফিরে যাওয়ার প্রয়াস আর কী!
সকাল বেলায় ডাবর হানির সঙ্গে লেবু জল খেয়ে শরীর চর্চা অনেক হয়েছে। কিন্তু মৌমাছির মতো ফুল থেকে সরাসরি মধুপান করার আনন্দ আলাদা। অনেকেরই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাবে। স্কুল থেকে ফেরার সময় পথের ধারে রঙ বেরঙের অগুন্তি কুটুস ফুল ফুটত। বিষাক্ত কি না সে ভয় তখন মনে ছিল না। এক একটা ফুল বৃন্ত থেকে ছাড়িয়ে তা চুষ চুষে মধু খাওয়ার সে এক অদ্ভুত আনন্দ। আরও একবার সেই পাগলামিটা করাই যায়। চেহারাটা বড় হতেই পারে। কিন্তু মনকে শিশুসুলভ রাখতে বাধা কোথায়!
এবার একটু জঠরগ্নি নির্বাপিত করতে হবে। টোস্ট অমলেটের কথা এখানে ভুলে যাওয়াই ভাল। তার বদলে মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালা দেওয়া একটা দোকানে বসে বললেই হল খিদে পেয়েছে। চিকুটি ময়লা একটা ধুতি, গলায় একটা তেলচিটে গামছা আর মাঝারি মাপের একটা ভুঁড়ি নিয়ে দোকানদার হাজির। একথালা মুড়ি আর দুটো গরম গরম চপ সঙ্গে সঙ্গে রেডি। অধিক রোমাঞ্চ চাইলে শালপাতার খোলাতেও মুড়ি খাওয়া যায়। সঙ্গে ঘুগনিও মিলতে পারে। খেত থেকে তোলা ননহাইব্রিড টাটকা শসা। সঙ্গে একটা গেঁড়া পেঁয়াজ আর লঙ্কা। শহুরে নাক সিঁটকোনোকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে খেয়ে নেওয়াই যায়। ইচ্ছে হলে কোনও এক গাছতলাতেও বসে খাওয়া যায়। ইউরিয়াহীন লালচে মুড়িতে তখন অমৃতের স্বাদ। লজ্জার কোনও কারণ নেই। ইচ্ছে হলে আরও মুড়ি আরও চপ খাওয়া যেতেই পারে। লঙ্কা খেয়ে ঝাল লাগতেই পারে। তার জন্য আছে গরমাগরম জিলিপি, লবঙ্গ লতিকা নামক অসাধারণ মিষ্টি। ফিগার কনসাস্‌ মনকে তখন ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে রাখাই শ্রেয়। রসগোল্লার দাম মাত্র তিনটাকা। পাঁচটাকার রসগোল্লাই এখানে সবথেকে বড় সাইজ। টেস্টও দারুণ। হঠাৎ মনে হতে পারে মধ্যযুগে চলে এসেছে। তিনটাকায় রসগোল্লা! যারা এক পিস রসগোল্লা পনের বা কুড়ি টাকা দিয়ে কিনে অভ্যস্ত তাদের চোখ কপালে ওঠারই কথা। তাও তো সে মিষ্টি সুজিতেই ভর্তি।
বাঁধনহীন হওয়ার আনন্দই আলাদা। আজ আর অন্তত নিজেকে শাসন নয়। মন যা চায় তাই করতে হবে, তাই খেতে হবে। তিনশো চৌষট্টি দিনই তো নিজেকে যাবতীয় শাসনে বেঁধে রাখি। একটা দিন হোক না শাসনহীন। ক্ষতি কী! এমন গ্রাম্য পরিবেশে, রোদ্দুর মাখানো নীল আকাশের নীচে দুজনের দুজনকে আবার নতুন করে ভাল লাগতে বাধ্য। জীবনসঙ্গীর এমন পাগলামো দেখে আবার হয়তো নতুন করে প্রেমে পড়াই যায়। কে জানত যে প্রত্যেকের মধ্যেই আলাদা একটা মানুষ বাস করে। যে বড্ড অপরিচিত। এমন একটা সুযোগ না আসলে তো কাছের মানুষের এমন রূপটা অদেখাই থেকে যেত।
খেয়ে দেয়ে এবার ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ালেই হল। গ্রামের দিকে গিয়ে দু একটা গ্রাম্য দুর্গার সঙ্গে দেখা করে এলে নেহাত মন্দ হয় না। কিন্তু এত জোড়া উৎসুক মানুষের চোখ এই দুটি পাগলকে গিলবে, যে অস্বস্তি হবারই কথা। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করাই যায়। গ্রামের একপাশে ছোট্ট দীঘি। সেখানে বেশ কয়েকটা পদ্ম ও ফুটে আছে। ছোট গ্রাম। লোকজনও কম। তাই পদ্ম গুলো বেঁচে আছে। শহর হলে কবেই পদ্মের বংশ ধ্বংস করে ছেড়ে দিত।
গরম থাকলেও পাশের মানুষটি এমন পাগলামোকে নীরব প্রশ্রয় দেওয়ায় ভাল লাগতে বাধ্য। কতদিন পরে দুশো ছ’টা হাড় দীর্ঘজীবি হবার আশীর্বাদ পাচ্ছে। ‘কোই মিল গ্যায়া’র জাদুর মতো তাদের খাবারও তো সূর্যালোক। ভিটামিন ডি পেয়ে তাদের আনন্দ তখন দেখে কে! ঘুরে বেড়িয়ে একটু ক্লান্ত হয়ে গেলে সোনাঝুরি গাছের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়াই যায়। চারিদিকে তখন হলুদ সোনাঝুরি ফুলের সমারোহ। নীল আকাশ, সবুজ পাতা আর তার মাঝে সোনালী বর্ণের ফুল। প্রকৃতির যে কত রূপ! জঙ্গলটা বেশ পরিষ্কার। মনে হতে পারে এই জঙ্গল এত পরিষ্কার কীভাবে? কারা পরিষ্কার করে। আসলে গ্রামের লোকেরা এই জঙ্গলের শুকনো পাতা তাদের নিত্য জ্বালানী রূপে কাজে লাগায়। তাই জঙ্গল পরিষ্কার। ইচ্ছে হলে গাছের ছায়ায় সঙ্গীর কোলে মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়। খুব ইচ্ছে হলে এই হারিয়ে যাওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে এই রোদেলা এই শরতের ছবি তোলা যায়। মুখে তখন খেলা করছে এক অদ্ভুত হাসি যার সাক্ষী হয়ে থাকলো ওই ছবিগুলো। এই হাসি নিজের হারিয়ে যাওয়াকে আবার নতুন করে ফিরে পাবার হাসি। ইচ্ছে হলে কিছুটা ভিডিও করে নিলে মন্দ হয় না। এমন মুহূর্ত তো বারবার আসে না এ জীবনে।

ফিরে আসার তাড়া না থাকলেও একসময় ফিরে আসতেই হয়। মনখারাপের বিষন্নতা নিয়ে নয়। বরং একরাশ আনন্দ নিয়ে। নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নয়। বরং গন্তব্যহীন গন্তব্যে গিয়ে যে এত আনন্দ জানা ছিল না। পুজোর সময় একটা দিন একটু অন্যভাবে। প্রচলিত ছন্দের বাইরে গিয়ে একটু পাগালামো। নিজের ফেলে আসা আমিকে আরও একবার খুঁজে পেতে। এমন ভ্রমণ একই সঙ্গে স্মরণীয় ও বরণীয়ও বটে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.