সেই সর্দারজিরা যদি ফিরে আসতেন!‌

কলকাতা থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাস্তায় ট্রাম দেখা যায় না। শীত এলে কাবুলিওয়ালা দেখা যায় না। রাস্তার ধারে খটাখট টাইপ রাইটার দেখা যায় না। সেই সর্দারজি ড্রাইভারদেরও আর কলকাতায় দেখা যায় না। লিখেছেন জগবন্ধু চ্যাটার্জি।।

কলকাতা থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাস্তায় ট্রাম দেখা যায় না। শীত এলে কাবুলিওয়ালা দেখা যায় না। রাস্তার ধারে খটাখট টাইপ রাইটার দেখা যায় না। সেই সর্দারজি ড্রাইভারদেরও আর কলকাতায় দেখা যায় না।

কেন জানি না, সর্দারজি ড্রাইভারদের প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে। খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ছে। আমার পিসি ট্যাক্সি থেকে নামার সময় ব্যাগটা গাড়িতে ফেলে এসেছিল। ধরেই নিয়েছিলাম, ওটা আর পাওয়া যাবে না। তাই থানায় জানানোও হয়নি। সন্ধে নাগাদ এক সর্দারজি হাজির। তিনি দেখেছেন একটা ব্যাগ পড়ে আছে। সন্ধে নাগাদ বাড়ি খুঁজে তিনি সেই ব্যাগ ফেরত দিয়ে গেলেন। সেই থেকে এই জাতিটাকে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। বড়রা অনেকেই বলেছিল, এটা বাঙালি বা বিহারি ড্রাইভার হলে ফেরত পাওয়া যেত না। সর্দারজি বলেই দিয়ে গেছে।

পরে, আমি যখনই ট্যাক্সি চড়েছি, চেষ্টা করেছি কোনও সর্দারজির গাড়িতে উঠতে। অধিকংশ সময়ই সর্দারজির গাড়ি পেতাম না। অন্য গাড়িতেই উঠতে হত। তখনই তফাতটা টের পেতাম। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধিকাংশ সর্দারজি দারুণ রাস্তা জানেন। অলি-গলিও চেনেন। কখনও আপনাকে অহেতুক ঘোরাবেন না। অন্তত পাঁচশোবার সর্দারজিদের ট্যাক্সিতে চেপেছি। আজ পর্যন্ত কোনওদিন বেশি ভাড়া চাইতে শুনিনি। তাঁরা খুচরো সঙ্গে রাখেন। যদি আটচল্লিশ টাকাও ভাড়া হয়, নিশ্চিত থাকুন, বাকি দু টাকা আপনি ফেরত পাবেন। যেটা অন্য ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে ঘটে না বললেই চলে।

sardarji3
তাঁরা এই শহরকে নিজের শহর বলেই মনে করেন। এই শহরের বা এই রাজ্যের নামে নিন্দে করতে শুনিনি। কখনও কোনও খারাপ ব্যবহার পেয়েছি বলে মনে পড়ছে না।
এমন মানুষেরা সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছেন। জানি না, তাঁদের ছেলেপুলেরা গাড়ি চালায় কিনা। কমবয়সী সর্দারজি তেমনভাবে চোখে পড়েনি। ট্যাক্সি নিয়ে মানুষের এত অভিযোগ, এত ভোগান্তি। তার মাঝে এই সর্দারজিরা হলেন মরুদ্যানের মতো। এমনও হয়েছে, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, বাস ধরব বলে। সেদিন হয়ত ট্যাক্সিতে যাওয়ার পরিকল্পনাও ছিল না। কিন্তু সর্দারজির খালি গাড়ি দেখলে হাত তুলে দিয়েছি। মনে হয়েছে, আজ ট্যাক্সিতেই যাওয়া যাক। হ্যাঁ, এই ভরসা, এই শ্রদ্ধা, এই ভালবাসা তাঁরা আদায় করে নিয়েছেন। কই, আমরা বাঙালিরা তো এতখানি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি।

শহর ঝাঁ চকচকে হবে। আরও ফ্লাইওভার হবে। ওলা-উবেরের পরিষেবা আরও ছড়িয়ে যাবে। কিন্তু সর্দারজিরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি ভরা এই শহরে তাঁদের দেখলেও কিছুটা তৃপ্তি পেতাম। কলকাতা, ওঁদের ছাড়া তুমিও কি ভালো থাকতে পারো ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.