শ্রীপর্ণা গাঙ্গুলি
সুমনের অনুষ্ঠান শুনলেই যাই। অন্তত যাওয়ার চেষ্টা করি। এবারও যখনই শুনলাম, নজরুল মঞ্চে সুমনের অনুষ্ঠান, পরের দিনই অনলাইনে টিকিট কেটে ফেলি।
সুমনের অধিকাংশ গানই আমার মুখস্থ। তবু যাই, এ যেন একটা নেশার মতো। যাই মূলত তাঁর কথার আকর্ষণে। তিনি যাই বলুন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, এমন করে তো আর কেউ ভাবতে বা বলতে পারে না। রাজনৈতিক ব্যাপারে তিনি যেগুলো বলেন, অনেক সময় তার সঙ্গে একমত নই। নাই বা হলাম। সেটুকু না হয় দ্বিমত থাকল। তাই বলে গান নিয়ে তাঁর এমন সুন্দর স্মৃতিচারণ শুনব না? কথার মাঝে মাঝেই থাকবে গান। নিজেকে তখন সেই গানের সাগরে সঁপে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ও গানওলা, আরেকটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।
গায়ক সুমন, গীতিকার সুমন, সুরকার সুমন। এই সব পরিচয়গুলোকে এখন আর বড় মনে হয় না। এগুলো নেহাতই একটা পরিচিতি। আমার কাছে সুমন মানে সেই লোকটা, যিনি বাংলা গানকে গুলে খেয়েছেন। রবি ঠাকুর থেকে অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল থেকে পান্নালাল, ধনঞ্জয় থেকে সতীনাথ, সলিল চৌধুরি থেকে অখিলবন্ধু ঘোষ–তিনি যেন বাংলা গানের এক চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। শৈশব থেকে কৈশোর, তারুণ্য থেকে যৌবন, ছুটেছেন সেই গানের পেছনেই। বিখ্যাত শিল্পী তো অনেকেই আছেন। কিন্তু এমনভাবে বাংলা গানকে আর কজন ভালবেসেছেন!
তাঁর জন্যই তো চিনেছি হিমাংশু দত্তকে। তাঁর জন্যই তো নতুন করে চিনেছি অ্যান্টনি কবিয়াল বা ভোলা ময়রাকে। তাঁর জন্যই তো নতুন করে খেয়াল শোনার ইচ্ছে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কী মূল্যবান এক সম্পদকে হেলায় হারাচ্ছি। বয়স সত্তর হয়ে গেল। স্বাভাবিক নিয়মেই গলা ভেঙে আসবে। স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে। তখন এই সব গান আর কে শোনাবেন? তিনি চলে গেলে হারিয়ে যাওয়া এই সব গানের গল্প আর কে বলবেন?
মনে হয়, আমার যদি প্রচুর টাকা থাকত, তাহলে তাঁকে একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে বলতাম, আপনার সামনে একটা রেকর্ডার রেখে গেলাম। রোজ একঘণ্টা করে বলে যাবেন। যা খুশি। যেদিন যাকে নিয়ে বলতে ইচ্ছে হবে, সেদিন তাঁকে নিয়েই বলবেন। যেদিন যে গান গাইতে ইচ্ছে হবে, সেই গান গাইবেন। যেদিন যাঁরে গালাগাল দিতে ইচ্ছে হবে, তাঁকে গালাগালই দেবেন। সেগুলো ভবিষ্যতের সম্পদ হয়ে থাকবে। সত্যিই একটা যুগ হয়ত হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা কি কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে পারি না?