এভাবেই শুরু এক আশ্চর্য নির্মাণ…চাঁদের পাহাড়

কাঁটায় কাঁটায় ১০.০৫ এ শেয়ালদা ঢুকল ডাউন বনগাঁ লোকাল। ট্রেন থকে নামলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। হাতে জ্বলন্ত বিড়ি, বগলে ভাঁজ করা বহু পুরানো একটা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক পত্রিকা। ইনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের এর বাংলার মাস্টার।

আপাতত তাঁর গন্তব্য কলুটোলা লেনের একটি একচিলতে ঘর। বর্তমানে ঘরটি কয়েকটি তের চোদ্দ বছরের কিশোরের দখলে। এরা সবাই খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল এর ছাত্র। তারাই ঘরটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছে। এলোমেলো হয়ে থাকা বই, কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখছে।স্কুলের সময় প্রায় হয়ে গেছে তবুও ছেলেগুলি এখন এখান থেকে নড়বে না।
স্যর যেদিন দেশের বাড়ি থেকে ফেরে, সেদিন এটাই তাদের রুটিন। তারা জানে স্যার বাড়ি থেকে খেয়ে আসেন না। নিচের পাইস হোটেলে খায়। স্যারের খাওয়া হলে তারা একসঙ্গে স্কুলে যাবে। আর তাছাড়া যা আপনভোলা মানুষ! তাড়াহুড়োর সময় হয়তো না খেয়েই চলে যাবে।

bibhuti bhushan4

স্যর ঘরে ঢুকতেই আবীর বললো:–
‘স্যার, ঠাকুর বললো আজ ভালো ইলিশ এসেছে..আপনার জন্য রাখতে বলেছি’।
‘ সে কি রে?
ইলিশের দাম জানিস?
আমার দু’দিনের খাওয়ার খরচ হয়ে যেত’।
‘ তা হোক স্যার, একদিন ই তো! চলুন, চলুন..ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে’।
ছেলেরা জানে জোর না করলে স্যার কোনদিন-ই ভালোমন্দ কিছু খাবে না। তাদের স্যার যে বড় গরীব!!
খাওয়ার পর গুরু শিষ্য সদলবলে ট্রামে চেপে চললো স্কুলে। ছুটির পর আবার খুদের দল। এবার সংখ্যায় আরও বেশি।
‘ তোরা এবার বাড়ি যা তো, সন্ধে হয়ে গেলে বাড়িতে বকবে।’
‘ বাড়িতে বলে এসেছি। আপনার সঙ্গে থাকলে মা বকে না’।
সবথেকে খুদে রফিক ততক্ষনে স্যারের আঙুল ধরেছে। তার ভয়, ছোট বলে পাছে তাকে স্যার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

ঘরে ফিরে এবার হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বেরোতে লাগল স্যারের জন্য আনা বিচিত্র সব খাদ্যসামগ্রী। চিনেবাদাম, ছোলাভাজা, তেঁতুলের আচার, শোনপাপড়ি …এরকম কত কী!
রফিক তার স্কুলব্যাগে নিয়ে এসেছে আস্ত ডিমসেদ্ধ। স্যার রাত্রে খাবে। রফিকের বাবা কাছেই চায়ের দোকান করে। খুবই গরীব। স্যারের চোখের কোনটা কী ভিজে উঠল ? কোথা থেকে আসে এইসব শাপভ্রষ্ট দেবশিশুর দল। এত মায়ার বাঁধন!

bibhuti bhusan3

বিচিত্র খাদ্যসামগ্রী দিয়ে বিচিত্রতর জলযোগ শেষ হল গুরুশিষ্য সকলের। সবাই গোল হয়ে বসল। মাঝখানে তাদের স্যার। শুরু হল গল্প বলা। মুহূর্তে মুছে গেল কলকাতা শহর, ট্রাম-বাসের আওয়াজ, মহানগরীর কল-কোলাহল। এক অলীক স্বপ্নরাজ্যে ঢুকে পড়েছে ছেলেরা..স্যর বলে চলেছেন…
“শঙ্কর একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে…”
এভাবেই শুরু এক আশ্চর্য নির্মাণ…

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কিশোর ক্ল্যাসিক “চাঁদের পাহাড়”। আর হ্যাঁ, ছাত্রদের চোখের মনি এই গরীব মাস্টার-ই অমর কথাশিল্পী বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যার হৃদয়ে ছাত্রদের জন্য সঞ্চিত ছিল এক সমুদ্রের ভালোবাসা। এঁর কথা স্মরণ করলেও পুণ্য হয়।

(‌সংগৃহীত)‌

web-banner-strip

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.