কখনও পাবেন পাথুরে রাস্তা। কোথাও আবার একটু সমতল মাটির রাস্তা। কোথাও গিয়ে দেখবেন পথ হারিয়ে গেছে গাছের ভিড়ে। শেকড় পেরিয়ে রাস্তা খুঁড়ে নিন। দুর্গম পথ, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যান। ছোট ছোট ভুটানি বস্তি। একটু জিরিয়ে নিন। দুচোখ মেলে দেখুন নিসর্গকে। ব্যস, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে আপনি পৌঁছে গেলেন এক পাহাড়ি উপত্যকায়।
না, পাকা রাস্তা নেই। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার উপায়ও নেই। ওঠার পরেও বিলাসবহুল কটেজ বা রাস্তোরাঁ পাবেন, এমন আশা না করাই ভাল। তবে যা পাবেন, আপনার দু চোখ জুড়িয়ে যাবে। মনে হবে, এই লেপচা খা-তে আগে কেন আসিনি!
আমাদের সঙ্গে থাকা এক শিক্ষক। নাম জ্যোতির্ময় রায়। অনেকদিন ধরেই বলছিল, ডুয়ার্স যাব। কিন্তু বৈচিত্র্যে ভরা ডুয়ার্সে তাকে কী দেখাব ? একদিকে পাহাড়ি নদী, একদিকে ঘন জঙ্গল। বইয়ে সেগুলোই পড়ে এসেছে। বন্ধুদের কাছে বহুচর্চিত কয়েকটা জায়গার নামই শুনে এসেছিল। মনে হল, একটু ব্যতিক্রমী জায়গায় নিয়ে গেলে কেমন হয় ? তাকে বলেছিলাম লেপচা খা-র কথা। জ্যোতিদা বলল, সেখানে কী আছে ? বললাম, পাহাড়ের ওপর গ্রাম। সে বলল, সমতলে এত এত গ্রাম থাকতে পাহাড়ি গ্রামে কেন থাকতে যাব ? যখন শুনল, ওপর পর্যন্ত গাড়ি ওঠে না, তখন আরও গালমন্দ শুরু করল।
মনে মনে বললাম, হে প্রকৃতি, এ জানে না, এ কী বলছে। একে তুমি ক্ষমা করো। পথ কতটা দুর্গম, ইচ্ছে করেই বলিনি। যদি শুনত ওই পাহাড়ি পথের পুরোটাই হেঁটে উঠতে হবে, আমি নিশ্চিত, সে রণে ভঙ্গ দিত। আর সে রণে ভঙ্গ দিলে আমাদেরও যাওয়া হত না। এদিক ওদিক জঙ্গল ভ্রমণ সেরে আমরা পাড়ি দিলাম সান্তালাবাড়ির দিকে। আলিপুরদুয়ার থেকে মোটামুটি এক ঘণ্টার পথ। আপনি যদি বক্সা পাহাড়ে যান, এই পথ দিয়েই যেতে হবে। আর গাড়ি যায় ওই সান্তালাবাড়ি পর্যন্ত। তারপর বাকি পথটা নিজের পায়ের ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।
তাহলে, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে উঠে পড়ি। কিন্তু কতদূর ? মাস্টারমশাইকে তো বলা যাবে না। একটা পবিত্র মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হল। এই তো একটু। যেতে যেতে বক্সা পড়বে। ওখানে একটু ঘুরে দেখব, একটু জিরিয়ে নেব। কিছু খেয়ে নেব। তারপর আরেকটু উঠলেই লেপচা খা। যত এগোই, বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও নিচে তাকালেই খাদ। কোথাও ছোট ছোট বনবস্তি। আবার একটু দূরে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদী। কোনটা কী নদী, সেটা জানার মতো কৌতূহল সেই সময় সেই মাস্টারমশাইয়ের ছিল না। তার তখন একটাই গান, কতদূর আর কতদূর। আমরা চোখ টেপাটেপি করে বলে চলেছিলাম, এই তো আর একটু। একটা সময় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তার বাক্যালঙ্কার অব্যয়ের তীব্রতা বেড়ে গেল। বাধ্য হয়ে কয়েকবার বিরতি নিতে হল। অবশ্য শুধু ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরাও কিছুটা হাপিয়ে গিয়েছিলাম। যেখানেই দাঁড়াচ্ছি, শুনতে হচ্ছে, ‘আর জায়গা পেলি না ? এখানে তোর বিয়ে দেব। শ্বশুরবাড়ি আসতে তোর দম বেরিয়ে যাবে।’ আবার কখনও বলছে, ‘পাহাড়ে উঠতে দে, যদি ভাল না লাগে, তোকে ওখান থেকে ঠেলে ফেলে দেব। তারপর পাহাড়ের উপর তোর স্মরণসভা করব।’ এ তো গেল সংসদীয় ভাষা। অসংসদীয় যা কিছু, তা উহ্য থাক।
এভাবেই আস্তে আস্তে পৌঁছে গেলাম বক্সায়। সময় লাগল ঘণ্টা দেড়েক। কখনও আমি, কখনও আমার সঙ্গে যাওয়া দুই দাদা শুভঙ্কর সরকার ও শীর্ষেন্দু সরকার জ্যোতিদাকে বোঝাতে লাগলাম বক্সা দুর্গের মাহাত্ম্য, এখানে কারা কারা বন্দী ছিলেন। স্মরণীয় সেসব ঘটনা। কিন্তু জ্যোতিদা শুনলে তো! পারলে আমাদেরই বক্সার জেলখানায় আটকে রাখে। খুব খিদে পেয়েছে, একটা দোকানে মিমি (অভিনেত্রী মিমি নয়, এটা ম্যাগির পার্বত্য সংস্করণ বলা যায়) খাওয়া হল। এতক্ষণে জ্যোতিদা একটু শান্ত। এবার পাড়ি দিলাম লেপচা খা-র দিকে। বক্সা থেকে ঠিক কতটা ? দুটো ছোট্ট তথ্যে এই সময় একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। বক্সার উচ্চতা ২২০০ ফুট। আর লেপচা খা-র প্রায় তিন হাজার ফুট।
এর মধ্যে আমাদের পোর্টারের কথা একটু বলে নেওয়া যাক। সঙ্গে ব্যাগপত্তর থাকলে সান্তালাবাড়ি থেকেই পোর্টার পেয়ে যাবেন। ঝুড়িতে করে সে সব ব্যাগ নিয়ে নেবে। কোথায় যেতে চান, তাকে শুধু বলে দিন। সে হনহন করে উঠে ঠিক রেখে দিয়ে চলে আসবে। সে যখন নেমে আসবে, তখন আপনি হয়ত অর্ধেক পথ উঠেছেন। আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হল। আমরা তখনও বক্সাতেও পৌঁছাইনি, আমাদের পোর্টার রঞ্জিত দেখলাম দিব্যি গান করতে করতে নেমে আসছে। সে আশ্বস্ত করল, কোনও চিন্তা নেই। আপনারা যান, দিদির ঘরে সব রেখে এসেছি। আপনারা আসছেন, সেটা বলেও এসেছি। কে এই দিদি ? সে কথায় পরে আসছি।
বক্সা থেকে ফের রওনা দিলাম লেপচা খা-র দিকে। জ্যোতিদা ততক্ষণে আমাদের চালাকিটা বুঝে ফেলেছে। আমরা মুখে বলছি, এই তো সামনে, প্রায় চলেই এসেছি। ও মনে মনে ধরে নিয়েছে, এখনও অনেকটা দূর। তাই এবার সে শান্ত। যা কিছু বাক্যালঙ্কার অব্যয়, সব মনে মনে। আমরাও মুখ টিপে টিপে হাসছি। আসলে, ততক্ষণে জায়গাটা একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করেছে। কারণ, পাহাড়ের ওপর থেকে নিচটা অসাধারণ লাগছিল। বক্সা থেকে আরও একঘণ্টা পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম লেপচা খায়ে।
ছোট্ট একটা গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর। সবমিলিয়ে গোটা তিরিশেক বাড়ি। এখানে দিদি মানে মমতা ব্যানার্জি নয়। এখানে দিদি মানে ফুক দেন ডুকপা। আসলে, পর্যটকরা এলে এখানে দিদির বাড়িতেই ওঠেন। আরও দু একটা বাড়ি আছে। সবমিলিয়ে পঁচিশজনের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একবার দিদির ঠিকানায় পৌঁছে গেলেই হল। আর আপনার কোনও চিন্তা নেই। যেতে যেতেই পেয়ে যাবেন গরম চা। চাইলে মোমোও তৈরি হয়ে যাবে নিমেশেই। আর কী কী খেতে চান, দিদিকে একটু জানিয়ে রাখুন। ঘরগুলো বেশ সুন্দর। দোহাই, হোটেলের আড়ম্বরের সঙ্গে তুলনা করবেন না। বরং দুটো দিন দিদির আন্তরিক আতিথেয়তা উপভোগ করুন।
পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে আপনি। অনেক দূরে ভুটানের সারি সারি পাহাড়। নদী, জঙ্গল, মেঘ সব আপনার পায়ের তলায়। এমনকি সূর্যও। দিনের আলো থাকতে থাকতে চারপাশটা একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। পশ্চিমে পড়বে কালজানি। পূর্বে পাবেন রায়ডাক নদী। মনে হবে, সূর্য যেন সেই নদীর গর্ভে ঘুমোতে গেল। সে এক অপরূপ দৃশ্য। মেঘ আর আকাশ তখন যেন মাখামাখি করছে। চোখ মেলে থাকুন দিগন্তে। আকাশ আর মাটি যেন পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে।
একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে। এত উঁচুতে বিদুৎ বলতে সোলার লাইট। জ্যোৎস্না রাতে নদীর আবছা ছবি ভেসে উঠতে পারে। কিন্তু নিচের ওই গ্রামগুলো ? টিমটিম করে জ্বলছে আলো। কোনওটা আঠাশ মাইল এলাকার। রাজাভাতখাওয়া কোনটা ? চিনতে না পারলে জিজ্ঞেস করে নিন। জয়ন্তীর আলোটা একটু কম। ওই তো, ওটা গাঙ্গুটিয়া বস্তির আলো। আর মাথার উপর জোনাকির মতো হাজার তারার মিছিল।
কিন্তু জ্যোতিদা কোথায় ? এই নির্জন পাহাড় থেকে রাতের অন্ধকারে ফেলে দেবে না তো ? দেখলাম, এখান-ওখানে গিয়ে মোবাইলের টাওয়ার খুঁজছে। বললাম, একটা দিন না হয় নাই বা কথা বললে। আমাকে ধমকে বলল, ‘তুই একটা গাধা। এমন সুন্দর একটা জায়গা। এমন ফিলিংসের কথা লোককে জানাব না ? তাহলে লোকে জানবে কী করে ? তুই যদি না বলতিস, তাহলে কি আমি জানতাম ?’ ফিরে গিয়ে বললেই তো পারো। আবার তেড়ে উঠল, ‘বিশ্বকাপ দেখতে রাত জাগিস কেন ? লাইভ দেখবি বলেই তো। আমি লাইভ কমেন্ট্রি দিতে চাই। পরে বলার মধ্যে কোনও রোমাঞ্চ নেই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, লাল সেলাম লেপচা খা।’
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। দুর্গম পথে যে জ্যোতিদার কণ্ঠে বাক্যালঙ্কারের লাইভ কমেন্ট্রি শুনছিলাম, সেই জ্যোতিদার কণ্ঠে মুগ্ধতার কবিতা! লেপচা খা, সত্যিই তোমাকে সেলাম। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় একজন মানুষের এমন রূপান্তর ঘটে যায় !