ঘুরে আসুন ভুটিয়া মার্কেটে

শীতের দুপুরে নানা মেলার পাশাপাশি ঘুরে আসুন ভুটিয়া মার্কেটে। এই অনলাইন শপিংয়ের যুগে কেমন আছে সেই ভুটিয়া মার্কেট ? ঘুরে দেখে এলেন সংহিতা বারুই।।

শীত আসার অনেক আগে থেকেই দেখতাম, মা- ঠাকুমাদের বাড়তি ব্যস্ততা। দুপুর হলেই তাঁরা বসে যেতেন নানা রঙের উল, কাঁটা নিয়ে। একটু শীত এলে ছাদে বসে সারা দুপুর বুনে যাওয়া। কারও হাতে সোয়েটার, কেউ বানাচ্ছেন টুপি, কেউ বা মাপলার। সেই দুপুরগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল!

ভেঙে গেল যৌথ পরিবারের কাঠামো। মা, কাকিমা, ঠাকুমা সবাই একসঙ্গে এই দৃশ্য আর তেমন দেখাও যায় না। কেউ ব্যস্ত সিরিয়াল দেখায়, কারও হাতে মোবাইল। মা কাকিমারাও ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন ফেসবুক, হোয়াটস আপে। দুপুরে বসে উল বোনার ফুরসত কোথায় ? টানা কয়েক দুপুরজুড়ে সোয়েটার বানানোর জন্য যে ধৈর্য আর যত্ন লাগে, তাই বা কোথায় ? হাতের সেই শৌখিন কাজ ? না, তাও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

DSCN0527

অতএব, ভরসা সেই বাজার। ভরসা সেই ভুটিয়া মার্কেট। কারও ভরসা শপিং মল। শপিং মলের কথা আপাতত থাক। আমরা বরং এই সুযোগে ভুটিয়া মার্কেটটা একটু ঘুরে আসি। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের সেই  ভুটিয়া মার্কেট বহুদিন ধরে পরিচিত একটা নাম। অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহ থেকে এই বাজার বসতে  শুরু করে। থাকে যাই যাই শীতের মরশুমেও। তবে ভুটিয়া মার্কেট নাম হলেও খুব বেশি ভুটিয়াদের দেখা নাও পেতে পারেন। তাছাড়া, ভুটানের হাতে বোনা শীতের পোশাকও খুব একটা পাবেন না। এখানে  যে সমস্ত  উলের পোশাক আসে তা মূলত লুধিয়ানা থেকেই আনা হয় ।

হাতে বোনা না মেশিনে বোনা ?

দিনের পর দিন হাতে বোনা যে বেশ সময়সাপেক্ষ, এটা আমাদের মা কাকিমাদের মতো ভুটিয়রাও দিব্যি বোঝেন। হাতে বোনা সোয়েটার বা শীতবস্ত্র এখন অনেকটাই সংখ্যালঘু। তাঁদের যুক্তি , ‘হাতে বুনতে অনেক  সময় লাগে । ততখানি শৌখিন ও হয় না। যে দাম চাইব, খদ্দের সেই দামও দিতে চায় না। লুধিয়ানা থেকে খুব সহজেই এসব পোশাক আনা যায় । এমনকি  ধারে নেওয়ার সুযোগও আছে ।

এই মার্কেটের নাম ভুটিয়া মার্কেট কেন? অনেকের কাছএই রাখা হল প্রশ্নটা। একেকজনের কাছ থেকে বেরিয়ে এল একেক রকম উত্তর। কয়েক জন দোকানদার জানালেন আজ থেকে ৩০  বছর  আগে যখন  প্রথম এই  দোকানগুলো বসতে শুরু করেছিল, তখন  বেশিরভাগ  ব্যবসায়ী তিব্বত থেকে আসত, তাদের পসরা নিয়ে । এই সব জায়গায় বহু বিহারিও ব্যবসা করত। কিন্ত তিব্বতিরা সংখ্যায় বেশি থাকত । আর বিহারিরা  তিব্বতিদের ভুটানি বলে ।  সেই সময় থেকে বাজারটার  নাম ভুটিয়া মার্কেট।’

এখানে দোকান পেতে গেলে কর্পোরেশনের  মাধ্যমে আসতে হয় । অস্থায়ী পরিচয় পত্র সেখান থেকেই দেওয়া  হয়। তবে এখানে দুই তরফের মুখিয়া থাকেন। কলকাতার মুখিয়া মহম্মদ সাবিদ। তাঁর অধীনে প্রায় বাইশটি দোকান । প্রত্যেকে হাজার টাকা করে দেয় । তবে এখানকার ব্যবসাটা বংশানুক্রমিক হয়ে গেছে । বাবার সময় থেকে ব্যবসা চলছে , বর্তমানেও রয়েছে।  তবে দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে যা মনে হল, অনেকেই ভবিষ্যতে ছেলেদের এই ব্যবসায় আনতে চাইছেন না। তাঁরা চাইছেন ছেলে পড়াশুনা শিখে অন্য কাজ করুক । কারণ,  ক্রেতাদের ঝামেলা সামলানো তাঁদের কাজ নয় ।

তিনমাস ধরে চলা এই ব্যবসায় , ব্যবসায়ীরা আসেন দার্জিলিং , আসাম , লাদাখ , নেপাল থেকে । দেশের বাড়িতে প্রত্যেকের কিছু  না কিছু  ব্যবসা , চাষবাস , হোটেল আছে তার থেকেও একটা গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় যেটা  নজর টেনেছে তা হল, এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে কলেজের অধ্যাপকও রয়েছেন। নাম জিটু , বয়স বত্রিশ  বছর । বর্তমানে কেন এই ব্যবসা চালাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন ,’অধ্যাপনার কাজে আসার আগে থেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম,  এই ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক। তাই , দুই মাস বাড়তি  কিছু উপার্জন হয়ে যায়। ‘

এভাবেই জমে উঠেছে ওয়েলিংটন স্কোয়্যার। দুপুর থেকে আনাগোনা শুরু, সন্ধেতে তা আরও বেড়ে যায়। তার মাঝেই চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর তার কারণ হল অনলাইন মার্কেটিং। এক দোকানদার বললেন, ‘এখন তো শুনছি ফ্লিপকার্টেও এসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। হয়ত অনেক কম দামেই পাওয়া যাবে। তখন আর কে এখানে এসে এসব কিনবে ? ঘরে বসে মোবাইল থেকেই অর্ডার দেওয়া শুরু হবে।’ ভুটানি বস্ত্র থেকে সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ওরা এনেছেন লুধিয়ানার জিনিস। এবার নতুন চ্যালেঞ্জকে সামাল দিতে ওঁদেরও হয়ত ঝুঁকতে হবে অনলাইনে। তখন এই ভুটিয়া মার্কেট থাকবে তো ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.