কীভাবে গড়ে উঠল কল্যাণী শহর? কে এই কল্যাণী? প্রশ্নটা অনেকদিনের। মুখে মুখে ফেরে। রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কেউ বলেন, বিধানবাবুর প্রেমিকা। কেউ বলেন, পালিতা কন্যা। আলো ফেললেন জগবন্ধু চ্যাটার্জি।
একটি ছোট্ট শহরে চারখানা রেলস্টেশন! তথ্যটা বেশ অবাক করার মতো। অথচ, কল্যাণী শহরে সত্যিই চারখানা স্টেশন আছে। কল্যাণী, ঘোষপাড়া, কল্যাণী সীমান্ত, কল্যাণী শিল্পাঞ্চল। দেশের খুব বেশি শহরে এমনটা আছে বলে মনে হয় না। এরকম আরও নানা অবাক করার মতো উপকরণ ছড়িয়ে আছে শহরের আনাচে কানাচে।
এই শহরের জন্মটাই তো অবাক করার মতো। স্রেফ কংগ্রেসের সম্মেলন উপলক্ষে একটা নগরীর গড়ে ওঠা, ক্রমশ তা বেড়ে ওঠা। যদিও তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর তাঁবু পড়েছিল এই এলাকায়। সৈনিকদের আসা যাওয়ার জন্য কিছু রাস্তাও তৈরি হয়েছিল। তখনও গড়ে ওঠেনি জনবসতি। আসল নির্মানযজ্ঞ শুরু হল স্বাধীনতার পর, কংগ্রেসের সম্মেলনকে ঘিরে। তখনকার দিনে এ আই সি সি–র অধিবেশন মানে বিরাট এক মহোৎসব। দেশের তাবড় তাবড় কংগ্রেস নেতারা আসতেন। বেশ কয়েকদিন ধরে থাকতেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের নানা দিক নির্ণয়ের পাশাপাশি এলাকায় যেন একটা মেলা বসে যেত। বিভিন্ন দোকান বসত। রাজনৈতিক মঞ্চের পাশাপাশি হত সাংস্কৃতিক মঞ্চ। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকত। স্থানীয় আয়োজকরা কী রকম আয়োজন করলেন, তার ওপর তাঁদের গুরুত্ব নির্ভর করত। কেউ দারুণভাবে আয়োজন করলে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব একধাক্কায় বেড়ে যেত। তাই বিভিন্ন রাজ্যের নেতাদের মধ্যে একটা প্রবনতা থাকত অন্যদের টেক্কা দেওয়ার।
সালটা ১৯৫০। সেবার এ আই সি সি অধিবেশন বাংলাতেই হওয়ার কথা। কিন্তু কোথায় করা যায়? এমন জায়গা, যেখানে রেল যোগাযোগ থাকবে, যাতায়াতের ভাল রাস্তা থাকবে। থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত থাকবে। চাইলে হয়ত কলকাতাতেই করা যেত। অথবা অন্য কোনও শহরকেও বেছে নেওয়া যেত। কিন্তু একটা চ্যালেঞ্জ নিতে চাইলেন বিধানচন্দ্র রায়। ঠিক করলেন, কলকাতায় হবে না। অন্য কোনও পরিচিত শহরেও হবে না। নতুন একটা অখ্যাত জায়গায় হবে এই সম্মেলন। সম্মেলন উপলক্ষেই গড়ে উঠবে নতুন নগরি। কোথায় করা যায়? কলকাতার উপকন্ঠেই একটা জায়গা বেছে নিতে হবে। বসলেন বিভিন্ন প্রযুক্তিবিদ ও স্থপতির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে তৈরি করে ফেললেন শহরের নকশা। শুরু হয়ে গেল নতুন নগরী গড়ে তোলার কাজ। একটি অংশে বিস্তীর্ন জায়গা ছেড়ে রাখলেন শিল্প স্থাপনের জন্য। এক জায়গায় সরকারি প্রতিষ্ঠান, তো আরেক অংশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি অংশে আবাসন। কোথাও খেলার মাঠ, কোথাও বিনোদন কেন্দ্র। কোথাও জলাশয়, কোথাও বনসৃজন। সবমিলিয়ে পরিকল্পনার স্পষ্টছাপ। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে এত বছর আগে এরকম এক আধুনিক
উপনগরীর কথা কীভাবে ভেবেছিলেন! তিনি যে কতখানি দূরদর্শী, তা সেই পরিকল্পনা থেকেই বোঝা যায়।
কিন্তু শহরের নাম কী হবে? ঠিক করলেন, কল্যাণী। কে এই কল্যাণী? এ নিয়ে নানা জল্পনা। কেউ বলেন, বিধানবাবুর প্রেমিকা। কেউ বলেন, কল্যাণী নামের একটি অনাথ মহিলাকে ছোট থেকেই বিধানবাবু নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন। সেই পালিতা কণ্যার নামেই উপনগরী। এই দুই জনশ্রুতির কথাই কিন্তু জেলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু অন্যরকম কথাই উঠে এল গবেষক তমাল সাহার কথায়। কল্যাণীর এই শিক্ষাবিদ দীর্ঘদিন ধরে বিধানবাবুর জীবনের নানাদিক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, ‘কল্যাণী বিধানবাবুর প্রেমিকা না পালিতা কণ্যা, এই নিয়ে বিতর্ক আছে। নানা জনশ্রুতিও আছে। ন্তুি আমি গবেষণা করতে গিয়ে এমন কিছুই খুঁজে পাইনি। কল্যাণী বলে কেউ ছিল বলে মনে হয় না। আসলে, কল্যাণ মানে তো উন্নয়ন। তখন উন্নয়ন কথাটার তেমন চল ছিল না। কথায় কথায় লোকে বলত, এলাকার কল্যাণ হোক, মানুষের কল্যাণ হোক। সেই কল্যাণের প্রতিক হিসেবেই নাম রাখা হয়েছে কল্যাণী।’ নিশ্চয় খুব ধুমধাম করে শহরের উদ্বোধন হয়েছিল! একেবারেই না। কংগ্রেস অধিবেশন ছাড়া শহরের উদ্বোধনকে ঘিরে আদৌ কোনও অনুষ্ঠান হয়েছিল, এমনটা শোনা যায় না। শুধু তাই নয়, অধিবেশনের পরেও আরও বারো বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধানবাবু। তমালবাবুর দাবি, এই বারো বছরে আর কখনও কল্যাণী এসেছেন, এমন কোনও প্রামাণ্য নথিও নেই। তবে কল্যাণীকে নিয়ে তাঁর নিজস্ব একটা ভাবনা ছিল। খোঁজখবর রাখতেন। মনের মধ্যে একটা আলাদা দুর্বলতা ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে আরও বড় বড় শিল্প আসত কল্যাণীতে। শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি, সব ব্যাপারেই এগিয়ে যেত কল্যাণী। কিন্তু সেই উন্নয়ন একটা সময়ে থমকে গিয়েছিল। সেইভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি কল্যাণীকে। নইলে রাজ্যের প্রথম তিনটি শহরের মধ্যে উঠে আসত কল্যাণীর নাম।’ কেন সেভাবে বেড়ে উঠল না কল্যাণী? আক্ষেপ আছে, সমালোচনা আছে। চাপানোতরও আছে। আছে একটা গর্ববোধ। সবমিলিয়েই কল্যাণী। রয়েছে নানা মুখরোচক গল্প। ছড়াতে ছড়াতে তা নিয়েছে জনশ্রুতির চেহারা। ইতিহাস যাই বলুক, তথ্য–প্রমাণ যাই বলুক, বিশ্বাস হয়ে গেঁথে আছে মনের ভেতরে।