ষোল বছরের ছোট্ট ছেলেটা কতকিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল!‌

জগবন্ধু চ্যাটার্জি

মাস তিনেক আগের কথা। হঠাৎই চমকে দিল এক ভারতীয় কিশোর। মাত্র ষোল বছরের ছেলেটা কিনা হারিয়ে দিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে!‌ মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় চার দশক আগের কথা। সেবার কিংবদন্তি ভিক্টর কর্শনয়কে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দিব্যেন্দু বড়ুয়া নামের ছোট্ট একটি ছেলে। কর্শনয় তো রেগে আগুন। এমন পুঁচকে ছেলের কাছে হার মেনে নিতে পারেননি।

সময় বদলেছে। ম্যাগনাস কার্সলেন অনেক শান্ত। দিব্যি মেনে নিয়েছিলেন নিজের হার। তিন মাস যেতে না যেতেই ফের চমক। বিস্ময় বালক রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ আবার হারিয়ে দিলেন কার্লসেনকে। প্রথমবার প্রজ্ঞার জয়টাকে অনেকে হয়ত ফ্লুক ভাবতেই পারেন। কার্লসেনের আত্মতুষ্টিও ভাবতে পারেন। দ্বিতীয়বার নিশ্চয় তেমনটা ছিল না। কারণ, আগেরবার যে পুঁচকে ছেলেটার কাছে হারতে হয়েছে, দ্বিতীয়বার তার বিরুদ্ধে অনেকটাই সতর্ক কার্লসেন। আর এই সতর্কতারই মাশুল দিতে হল। ছোট্ট একটা ভুল ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

একের পর এক বাধা টপকে তামিলনাড়ুর এই বিস্ময়বালক পৌঁছে গেল চেসেবল মাস্টার্স দাবার ফাইনালে। পথটা খুব মসৃণ ছিল না। পেরিয়ে আসতে হয়েছে একের পর এক শক্ত বাধা। কখনও হারিয়েছে বিশ্বের ২২ নম্বরকে, কখনও বিশ্বের ১০ নম্বরকে। ফাইনালেও উল্টোদিকে ছিলেন বিশ্বের ২ নম্বর চীনের ডিং লিরেন। প্রজ্ঞা প্রথমদিন কিছুটা ব্যাকফুটে। পরেরদিন দুরন্ত কামব্যাক। ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। একেবারে শেষপর্বে গিয়ে হারতে হল ঠিকই, কিন্তু বিশ্ব দাবায় দারুণ একটা ছাপ রেখে গেল ষোল বছরের প্রজ্ঞা।

মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দু–‌দু’‌বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানো!‌ এরকম একটা প্রেস্টিজিয়াস টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছে যাওয়া!‌ অথচ, তার পরেও কী সহজভাবেই না বাঁচতে পারে এই ছোট্ট ছেলেটা। ভারতের সময় মেনে তো আর বিশ্ব দাবা পরিচালিত হয় না। তাই অনলাইনে খেলা চলেছে রাত আড়াইটে পর্যন্ত। তারপর ঘুমোতে ঘুমোতে ভোর চারটে। সকাল সাতটায় উঠেই ক্লাস ইলেভেনের ছেলেটা বেরিয়ে পড়ল স্কুলের উদ্দেশে। সকাল পৌনে নটা থেকে পরীক্ষা। ক্লাসের দিনগুলো দু একদিন না গেলেও চলে। কিন্তু পরীক্ষা তো না দিলেই নয়। তাই রাত আড়াইটে পর্যন্ত বিশ্বের কিংবদন্তি দাবাড়ুদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পরেও সকালে উঠে দিব্যি পরীক্ষা দিতে পৌঁছে যায়। আবার পরীক্ষা শেষ হলেই পরের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে রাত নাগাদ ফের দাবার লড়াই। ফের সামনে কোনও এক কিংবদন্তি।

প্রজ্ঞার স্কুলের বন্ধুরা হয়ত জানতেও পারল না আগের রাতেই ছেলেটা হারিয়েছে বিশ্বের এক নম্বরকে। পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক শক্ত বাধা। প্রজ্ঞা যে ধরনের লাজুক ছেলে, নিজে থেকে এসব বলার পাত্র নয়। স্যারদেরও অনেকেই জানেন না আগের রাতে কী মিরাক্যাল ঘটিয়ে ফেলেছে তাদের ছাত্র। আমরা কত অল্পেই আত্মরতিতে ভুগি। আইসক্রিম খেলে সেটাও সোশ্যাল মিডিয়ায় না জানানো পর্যন্ত তৃপ্তি পাই না। আর এই ছেলে কিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারিয়েও চুপচাপ স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসে। কেউ জানতেও পারে না। সত্যি, ষোল বছরের এই ছোট্ট ছেলেটা আমাদের কতকিছু শিখিয়ে গেল!‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.