শরৎবাবুর লেখা টিভি সিরিয়ালের উন্নত সংস্করণ

নন্দ ঘোষের কড়চা

আপনার সবথেকে বিখ্যাত রচনা দিয়েই শুরু করি। শ্রীকান্ত। উপন্যাসটার নামকরণেই গলদ আছে। ওটার নাম হওয়া উচিত ছিল ইন্দ্রনাথ। কারণ ইন্দ্রনাথের পর, মানে প্রথম খণ্ডের পর উপন্যাসটার আর কিছু নেই। বাকি তিনটে খণ্ডর মধ্যে একমাত্র অভয়ার অংশটুকু পড়া যায়। বাকি অংশটা কেন লিখেছেন বোঝা দুষ্কর।

যদি নিজের জীবনের কথাই বলার ছিল, তাহলে শ্রীকান্তকে টেনে টেনে বড় না করে আত্মজীবনীই লিখতে পারতেন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে কবে কী কেলোর কীর্তি ঘটিয়েছেন, তা সরাসরি বললেই পারতেন। তাতে কিছু লোক হয়তো ছিঃ ছিঃ করত, কিন্তু লেখাটা অনেক ভালো হত। বাঙালি পাঠকের হজম হবে কি হবে না এই ভেবে সাহিত্যের বারোটা বাজালেন।

sharatchandra5

আসলে দীর্ঘ লেখা, ভারিক্কি ভাষায় লেখা আপনাকে মানায় না। আপনার ভাষা গ্রাম্য মেয়ের মতোই সরল, আটপৌরে। তাকে শহুরে, সাবধানী হালচালে মানাবে কেন। শ্রীকান্তকে অকারণে দীর্ঘ করতে গিয়ে গোল পাকিয়েছিলেন। আর গোল পাকিয়েছিলেন ভারিক্কি ভাষায় দত্তা, গৃহদাহ লিখতে গিয়ে। আপনি এত বড় সাহিত্যিক হয়েও বুঝতে পারলেন না, আপনার আসল জায়গা পল্লীসমাজ, বামুনের মেয়ে। ওটাই আপনার হোম গ্রাউণ্ড, ঘরের মাঠ। দত্তা, গৃহদাহ পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গোরা, যোগাযোগের ভাষা ধার করা।

আপনাকে যদি সামনে পেতাম, তাহলে বলতাম উপন্যাস না লিখে আরও বেশি করে ছোট গল্প লিখুন। বিশ্বাস করুন আপনার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি শ্রীকান্ত নয়, এমনকি পথের দাবিও নয়। শ্রেষ্ঠ হল মহেশ। কিন্তু আপনি অকারণে গাদা গাদা উপন্যাস লিখলেন। হ্যাঁ অকারণে লিখলেন। কারণ বলুন তো দেবদাস, অরক্ষণীয়া, বৈকুণ্ঠের উইল এইসব উপন্যাসে কী আছে? কিছুই নেই। দেবদাস তো একটি অতি রদ্দি রচনা।

আপনার সবথেকে বড় গুণ আপনার লেখা মহিলারাও গোগ্রাসে পড়েছেন। কিন্তু আপনার এই লেখাগুলো আজকের সিরিয়ালের উন্নত সংস্করণ। সিরিয়ালে যেমন একটি করে দজ্জাল মহিলা থাকে, যারা সংসারে আগুন লাগায়। সিরিয়ালে যেমন অধিকাংশ পুরুষ হয় বদমাশ নয় মেনিমুখো। আপনার লেখাতেও তাই। আপনার উচিত ছিল ওই সব প্যাছাল না লিখে মহিলাদের জন্য আরও সুন্দর সুন্দর গল্প, উপন্যাস লেখা। যাতে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। কিন্তু আপনি জনপ্রিয়তার রাস্তায় হাঁটলেন। এমনিতে সহজ ভাষায় লেখেন কিন্তু “নারীর মূল্য” কঠিন ভাষায় লিখলেন। কেন? আপনি কি কঠিন বিষয়কে সহজ ভাষায় লিখতে পারতেন না? মহেশ, অভাগীর স্বর্গের মতো গল্প আরও লিখে আপনি জাতপাত, ধর্মের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও জোরদার করতে পারতেন না?‌ নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু সেই কাজ না করার জন্য নন্দ ঘোষের হাত থেকে আপনিও রেহাই পেলেন না।

(‌নন্দ ঘোষের কড়চা। বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় একটি ফিচার। নন্দ ঘোষের কাজই হল সবকিছুকেই একটু বাঁকা চোখে দেখা। তাঁর শিকারের তালিকা থেকে কারও নিস্তার নেই। এই কলামকে নিছক মজা হিসেবেই দেখুন। লক্ষ্য রাখুন, নন্দ ঘোষের পরবর্তী শিকার কে, সেইদিকে। )‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.