লটারির ফাঁদে তলিয়ে যাচ্ছে জঙ্গল মহল

মধুসূদন মাহাতো

‌জঙ্গলমহলে দু’‌জনের দু’‌কোটি টাকা জিত৷ একজন খাতড়ার মেঝারিগোড়ার কেউ, অন্যজন রানিবাঁধের গুনপুরা গ্রামের৷ চারদিকে বিরাট হই হই কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার! নাকি লটারির টিকিটে প্রাইজ লেগেছে!
ওরা আদৌও পেয়েছে কি না? টাকাটা হাতে এসেছে কি না? এতক্ষণে যদি টাকাটা পেয়েও গেছে, যারা পেয়েছে তারা যতটা না আত্মহারা, তার চেয়ে বাকীই কাস্টমারদের শতগুন বেশি উল্লাস৷
হঠাৎ যদি ধনী হওয়া যায়, হঠাৎ যদি গাড়ি–‌বাড়ির মালিক হওয়া যায়, তবে সেটা কে না চায়! পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে কিম্বা বিন্দু বিন্দু দিয়ে সিন্ধু তৈরি করতে মানুষের ধৈর্য কোথায়!

যদিও লটারি শুরু এভাবেই, টিকিট কাটা শুরু হয় বিন্দু বিন্দু থেকেই। প্রথমদিকে ভাগ্য(!)কে যাচাই করতে এক আধদিন টিকিট কাটা হলেও ধীরে ধীরে তার গতি বাড়ে, পরিমাণ বাড়ে এবং অবশেষে নেশা বাড়ে। এক সময় লটারি টিকিট কাটার নেশা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মাদকাসক্তদের মতোই লটারি টিকিট কাটার নেশা পরিত্যাগ করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিবারে সংসারে অশান্তি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।


বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের বাজারগুলির কথা ছেড়ে দিলাম, ছোটখাটো মোড়গুলিতে এখন গড়ে পাঁচ সাতটা লটারির এজেন্সি৷ মোড়গুলির বাকি দোকানগুলিতে কেনাবেচা ঠিকঠাক না চললেও লটারি এজেন্সিগুলির ব্যবসা বেশ রমরমা। এখন তিন বেলার চলে খেলা এবং খেলার ফলাফল প্রকাশ। সব দোকান খোলার আগেই ধূপধুনা দিয়ে কালীর ফোটোয় টাটকা ফুলের মালা ঝুলিয়ে সকাল সকাল খুলে যায় লটারির দোকান। একটা টেবিল আর একটা চেয়ার, ব্যাস! এই পরিকাঠামোই নিমেষে হাজার হাজার টাকার ব্যবসা। যে ব্যবসায় খদ্দের-দোকানদার দরকষাকষি নেই, বিল ভাউচার নেই, ঠোঙা – ক্যারিব্যাগের ব্যবহার নেই, এমনকি খদ্দেরকে বসতে দেওয়ার আসনেরও প্রয়োজন নেই। খদ্দের আসবে নম্বর একটু বাছাবাছি করবে এবং টিকিট নিয়ে চলে যাবে। একটু ভিড় বাড়ে যখন রেজাল্ট শিট টেবিলে আসে৷ বাকি সময় নির্বিকার ব্যবসা।

জঙ্গলমহলের প্রত্যন্তরের মোড়গুলিতে খদ্দের বাড়ে সন্ধ্যার দিকে। দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, মুনিষ মাহিন্দাররা সারাদিনের কাজের শেষে মজুরি পেয়ে সানন্দে সন্ধ্যায় লটারির দোকানে এসে হাজির হয়ে যায়। এই মানুষগুলোর সারাদিনের ঘাম ঝরানো পারিশ্রমিকের একটা মোটা অংশই চলে চলে যায় লটারির দানে। এভাবেই সকাল-সন্ধ্যা জঙ্গলমহলের নানা প্রান্তের গ্রামীণ রোজগারের কোটি কোটি টাকা লটারি মাফিয়াদের কাছে চলে যায়। আর লটারির নামে এই জুয়া প্রতিদিন তাড়িয়ে নিয়ে যায় গ্রাম জীবনকে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দেওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে লটারির রমরমা ব্যবসা। লটারিতে আসক্তি বাড়ছে প্রতিদিন। বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে এই আসক্তির মাত্রা ছাড়াচ্ছে। লটারি ব্যবসার মধ্যে কতটা বৈধ, কতটা অবৈধতা রয়েছে তা এজেন্টরাও জানে না। কত টিকিটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়, কিংবা হিসাবের পরেও বাড়তি টিকিট ছাপানো হয় কিনা, সেসব প্রশ্ন এজেন্টদের কাছে অবান্তর। এজেন্টরা মূল ডিস্ট্রিবিউটারের কাছ থেকে টিকিট আনা এবং টিকিট বেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ভাগ্য ফেরানো, ভাগ্যবান হওয়ার অদৃশ্য হাতছানি এভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে চলেছে প্রতিদিন।

জঙ্গলমহলের একটা ব্লকের লটারি বিক্রির হিসাব জানলেই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার অবস্থা! শুধুমাত্র রানিবাঁধ ব্লকের দেড় শতাধিক এজেন্সি প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ টাকার টিকিট কেনাবেচা করে। অথচ পুরস্কার হিসেবে প্রতিদিন এক লক্ষ টাকাও ফেরত আসে না। সারা মাসে মাত্র একটা ব্লক থেকেই প্রায় দু’কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। অর্থাৎ এভাবেই লটারির নামে প্রতি মাসে প্রায় জঙ্গলমহল থেকে প্রায় ৫০—৬০কোটি টাকা মেহনতী মানুষের পকেট থেকে খসে যায়। যে টাকা জঙ্গলমহলকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কাজে সাহায্য করতে পরতো।

আর লটারিতে সাইকোলজিক্যালিভাবে বিজনেসটা এইরকম যে, সদ্য এক কোটি টাকার পুরস্কার এসেছে মানে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০কোটি টাকা তুলে নেবে এই জায়গা থেকেই৷ যারা জঙ্গলমহলে বাস করছেন তারা হাতেনাতে প্রমাণ পাবেন লটারি সেন্টারগুলির পাশাপাশি গেলেই৷ হঠাৎ কী হারে ভিড় বেড়ে গেছে, মানেই একটা প্রাইজে কীভাবে মানুষ জনমোহিনী হয়েছে!
জঙ্গলমহলের অর্থনীতির কোমর ভেঙ্গে যাচ্ছে। সরকারের কোনও হেলদোল নেই। বরং কোষাগারে আয় বাড়ানোর তাগিদে লটারি ব্যবসায় উৎসাহই জুগিয়ে যাচ্ছে উদাসীন সরকার। সরকারের একমাত্র আয় বাড়ানোই যখন লক্ষ্য তখন মানব উন্নয়ন গৌণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকার এগিয়ে আসবে না। মানুষকে জাগাতে হবে, শুভবুদ্ধির উদয় ঘটাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জঙ্গলমহলকে বাঁচাতে হবে৷

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.