সাবেকিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার বিরোধ আবহমানকাল ধরেই। ক্যামেরার ক্ষেত্রেও এই লড়াই তুঙ্গে। রিল ক্যামেরা বনাম ডিজিটাল ক্যামেরার দ্বন্দ্বের কথা শুনে ফেললেন অয়ন দাস।।
মহালয়ার দিন সকালে, দুপুরে কুমোরটুলি, বিকেলে উদ্বোধন না হওয়া পুজো প্যান্ডেলে ঘুরে ক্লান্ত ডিজিটাল ক্যামেরা। আজ সারাদিন কী খাটনিটাই না গেল ! প্রতি বছর মহালয়ায় যেন ‘ক্যামেরা পক্ষ’-এর সূচনা হয়। তোর তো মজাই মজাই, কোনও কাজ নেই।
রিল ক্যামেরাঃ ইয়ার্কি করছিস আমার কাজ নেই বলে! তোর জন্মানোর আগে থেকেই আমি ছবি তুলি। কিন্তু তুই হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হতেই আমার জীবনের সব ‘ফ্লাশ’ নিভে গেল।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ সে তো হবেই। দেখ আমায়! যখন খুশি পট পট লক্ষ লক্ষ ছবি তুলতে পারি। ছবি খারাপ হলেও ছবি ‘ডিলিট’ করে দিলেই হল । আবার ইচ্ছা মতো কম্পিউটারে ছবি নিয়ে রাখা যায়। তোর তো গুচ্ছের টাকা দিয়ে একটা ‘রিল’ কিনে ৩৫-৩৬ টার বেশি ছবি তোলা যায় না, তার জন্য আবার ‘রিল’ ‘ওয়াশ’ করতে হয়।
রিল ক্যামেরাঃ তাতে কী! ছবি ‘ওয়াশ’ করবে বলে কত ‘স্টুডিও’ খুলেছিল জানিস! আমার জন্য কত লোকের রোজগার হত।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ আমিও কম যাই নাকি! ছোকরা গুলো উত্তেজনার বশে আমায় কেনে তো বটে। কিন্তু সামলাতে পারে না। দু’দিন ছাড়াই আমার ‘চোখ’ খারাপ করে দোকানে দিয়ে আসে।
রিল ক্যামেরাঃ দেখ তাহলে! আগে ক্যামেরার মর্যাদাই আলাদা ছিল, এখন তো মোচা-কাঁচকলা সবার হাতেই তুই।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ তুই ওই মর্যাদাই কর।‘সর্বশিক্ষা অভিযান’-এর মতো আমিও ‘সর্বক্যামেরা অভিযান’ শুরু করেছি। এই যে দূর্গাপুজো আসছে, লোকে কোথায় ঠাকুর দেখবে জানিস!-আমার মধ্য দিয়ে। আগে লোকে বছরে একবারই প্যান্ডেলে দূর্গা-দর্শন করত। আর এখন আমার জন্যই প্যান্ডেলে ঢোকার ১৫০কিমি আগে থেকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলে বাড়িতে এসে সারাবছর ধরে দূর্গা-দর্শন করে।
রিল ক্যামেরাঃ হ্যাঁ।বছর খানেক পর প্যান্ডেলে ধাক্কা-ধাক্কি না করে ‘ড্রোন-ক্যামেরা’য় ছবি তুলে এনে দূর্গা-দর্শন করবে।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ সেটাও তো আমার জন্যই পারবে। কুমোরটুলিতে কেন এত ভিড় হয় জানিস! আমার জন্য শুধুমাত্র। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাপিছু ১০টাকা করে নেবার বুদ্ধি দিয়ে এদের ‘বিজনেস’-এর উপায়ও বাতলে দিলাম।
রিল ক্যামেরাঃ ভাগ্যিস ‘তেলেভাজা’-র মতো এই ‘বিজনেস’-কে ‘শিল্প’ আখ্যা দিস নি।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ তুই ওইসবই ভাব। আগে লোকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে দূর্গা-দর্শন করত।এখন দূর্গাঠাকুর আর লোকের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছি।
রিল ক্যামেরাঃ তাই!কী করে?
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ কুমোরটুলিতে গিয়ে দেখবি দেবী দূর্গার হাতে, কোলে উঠে ‘পোজ’ দিয়ে লোকজন ছবি তুলছে। এটা তো শুধুমাত্র আমার জন্যই সম্ভবপর হয়েছে।
রিল ক্যামেরাঃ দূর্গাঠাকুরের শান্তিটাও কেড়ে নিচ্ছিস! তারপর প্রতিমা শিল্পীদের কাজ করতে না দিয়ে ‘তোকে’ হাতে নিয়ে লোকে লাফালাফি করে।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ তুইও আদ্যিকালের বুড়ো আর বুদ্ধি গুলোও আদিকালে পড়ে আছে।দূর্গাঠাকুর তো তৈরিই করে লোকে যাতে দেখতে পায়। একটু-আধটু না হয় করেছে।তাতে হয়েছে টা কী!সবেতে সমালোচনা তোর!
রিল ক্যামেরাঃ তা বলে লাফালাফি করবে!এখন তো তোরা সিংহকে অব্দি ছাড়িস না, মুখের ভিতরে ঢুকে যাস।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ আবার সেই! আমার জন্য এখন ঘরে ঘরে ‘মডেল’ পাওয়া যায়। সেদিন মার্ক জুকেরবার্গ ফোন করে আমায় ধন্যবাদ জানালো। বললো আমার জন্যই ‘ফেসবুক’-এর ‘দেওয়ালে’ ‘ফটোগ্রাফার’-রা ঝুলে থাকে।
রিল ক্যামেরাঃ তা তো থাকবেই। আগে ছবি তুলতে গেলে তো বুকের পাটার দরকার হতো। এখন তো ‘এডিটং সফটওয়্যার’-এর গুঁতোয় কলকাতায় ‘অরোরা বেরিলেসিস’ পর্যন্ত এনে দেয়।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ কী সৌভাগ্য বল তাহলে। নরওয়ে-তে না গিয়েই কলকাতাতেই দেখতে পাচ্ছিস। তাছাড়া আমার আরেকটা ‘বিশেষ গুণ’ তো বলাই হয়নি তোকে। এই যে চিত্রসাংবাদিকরা খবরের জন্য ছবি তুলতে গিয়ে মার খেলো।‘তুই’ হলে ‘তোর’ রিলটাই খুলে নিতো।আবার অতো টাকা দিয়ে নতুন রিল কিনতে হতো।আর এখন খুব জোর ছবিগুলো ‘ডিলিট’ করে দেবে।
রিল ক্যামেরাঃ তা ঠিক।কিন্তু তবুও রিল ক্যামেরাতে সত্যিকারের ‘ফটোগ্রাফার’-রা ছাড়া যে সে ছবি তুলতে পারবে না।
ডিজিটাল ক্যামেরাঃ তাতে কী! এখন ছেলের হাতে ‘ডিএসএলআর’-‘এসএলআর’ না থাকলে মেয়ের বাবা বিয়েও দেবে না। তুই বরং আলমারির এককোণেই পড়ে থাক-‘ইন্ডিয়া’ যে ‘ডিজিটাল’ হচ্ছে।
(বেঙ্গল টাইমস পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত। অনলাইনে পুজো সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে।)
পুজো সংখ্যার লিঙ্কঃ
https://www.bengaltimes.in/sharadiya/Bengaltimes-SaradSankalan-1422.pdf