খোলা চিঠিঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
কমরেড, ফিরে চলুন চোদ্দ বছর আগের সেই বিকেলে
স্বরূপ গোস্বামী
অন্যদিনের মতোই আজকেও উঠেছেন বেশ সকালে। কাগজে চোখ বোলানো অনেকদিনের অভ্যেস। হয়ত আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখন তো আবার দুদিনের রাজ্য কমিটির সভা চলছে। কাগজে কারাত বনাম ইয়েচুরি লাইনের দ্বন্দ্ব পড়ে কখনও হয়ত মনে মনে হেসেছেন বা বোকা বোকা ব্যাখ্যায় বিরক্তও হয়েছেন। স্নান-টান সেরে সেই সকালেই আপনার গাড়ি পাড়ি দিয়েছে আলিমুদ্দিনের দিকে।
নানা জেলার নেতাদের সঙ্গে আগের দিনও দেখা হয়েছে। আজ আবার হওয়ার কথা। এই সভা আর দশটা গড়পড়তা সভার মতো নয়। যুক্তি-পাল্টা যুক্তির স্রোত চলতেই থাকবে। তার মাঝে আপনাকেও হয়ত কিছু বলতে হবে। হয়ত সেই কথার ভুল ব্যাখ্যাও হবে। হয়ত অনেক অপ্রিয় কথা শুনতেও হতে পারে। এ আর নতুন কী! কত নোঙরা আক্রমণই তো ধেয়ে এসেছে। কখনও বিরোধীরা, কখনও মিডিয়া, কখনও শরিকরা, তো কখনও দলের ভেতরেই অন্যরা। আর ‘সবজান্তা’ পাবলিক তো আছেই।
আগে মহাকরণ থেকে আপনার কনভয় সোজা চলে যেত নন্দনের দিকে। কতদিন আপনার প্রিয় নন্দনে যাননি! বিশ্বাস করুন, যখনই ওই চত্ত্বরে যাই, আপনার মুখটাই সবার আগে মনে পড়ে। একজন মুখ্যমন্ত্রী কত সহজভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। দশটা গাড়ির কনভয় নেই। পুলিশের ছয়লাপ নেই। হেঁ হেঁ করা, ধামাধরা পারিষদরা নেই। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা, সংস্কৃতি মনষ্ক একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ। সেই দৃশ্য কি নন্দনে আর দেখা যাবে? জানি না। আচ্ছা, সন্ধেবেলায় যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখন নন্দনের কথা মনে পড়ে না?
আজ বরং নন্দনের কথা থাক। আজকের দিনটা আপনার মনে আছে ? মনে না থাকারই কথা। পিছিয়ে চলুন ঠিক চোদ্দ বছর আগে। এবার নিশ্চয় মনে পড়েছে। এমনই এক বিকেলে আপনি রাজভবন থেকে এলেন নেতাজি ইনডোরে। হ্যাঁ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আজকের দিনেই আপনার অভিষেক। একদিকে জ্যোতিবাবুর বিদায়। অন্যদিকে আপনার নতুন পথ চলার শুরু।
মনে আছে, আমি আর আমার এক বন্ধু কলেজ স্ট্রীটের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে সোজা এসেছিলাম নেতাজি ইনডোরে। রাজভবনে ঢোকার ছাড়পত্র নাইবা থাকল, নেতাজি ইনডোরে তো ছিল। একই সঙ্গে জ্যোতিবাবুর বিদায় সংবর্ধনা, আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য আপনাকে সংবর্ধনা। একদিকে বিদায়ের বিষণ্ণতা, অন্যদিকে নতুনকে ঘিরে প্রত্যাশা। সেখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, ‘আমাদের পা থাকবে মাটিতে। এই মাটি থেকে যেন কখনও সরে না যাই।’ যতদূর মনে পড়ছে, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ স্লোগানটাও সেদিনই শুনেছিলাম। শেষ করলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতা দিয়ে ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’
শুরুটা তো মন্দ হয়নি। আপনি ক্রিকেটের অনুরাগী, তাই ক্রিকেটের ভাষাতেই বলি, ব্যাটের মাঝখান দিয়েই খেলছিলেন। সংবেদনশীল এক মুখ্যমন্ত্রী, সংবেদনশীল একটা সরকার। ঠিক ছ মাসের মাথায় বিধানসভা নির্বাচন। বিরাট জয় এল আপনার নেতৃত্বে। পরের পাঁচটা বছর দম ফেলারও ফুরসত ছিল না। রাজ্যে শিল্প আনার জন্য সমানে লড়াই করে যেতে হয়েছে। উন্নয়নে একেবারেই সামনের সারিতে উঠে আসছিল আমাদের বাংলা। এমনকি যে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বরাবর মুখ ফিরিয়ে থাকত, বাসে-ট্রামে-মেট্রোয় নানা টিপ্পনি কাটত, তাঁরাও দেখলাম, বাম অনুরাগী হয়ে পড়ছেন। ‘বুর্জোয়া’ কাগজেও সুরবদল! বলা হল, সিপিএম খারাপ হলেও আপনি ভাল। পরেরবার তো (২০০৬) জয় এল আরও বড় ব্যবধানে। জয়ের দিনই এসে গেল টাটার কারখানার ঘোষণা। বুদ্ধ থেকে একেবারে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’। সব ঠিকঠাকই তো চলছিল। তারপর কী যে হয়ে গেল!
থাক এসব কথা। কোথায় ভুল, কীসের ভুল, তা নিয়ে বহু জায়গায় বহু আলোচনা হয়েছে। কেউ আপনাকে কাঠগড়ায় তুলে, কেউ বিকৃত আক্রমণ করে আনন্দ পেয়েছেন। কিন্তু আপনি স্বভাবসিদ্ধভাবেই সংযত থেকেছেন। আপনার সামান্য কথাকে নিয়েও কত সময় কত বিতর্ক তোলা হয়েছে! কী আশ্চর্য, এখনও সেই বিকৃত প্রচারের বিরাম নেই। এখনও কিছু হলেই বলা হয় ‘আমরা-ওরা’। বলা হয় ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩৫’। কেউ কথাগুলোর পটভূমি বোঝার চেষ্টা করে না। এমনকি টিভিতে বিতর্ক করা ওই বিদ্বজ্জনরাও ভুল ব্যাখ্যা করেই চলেন। বিশ্বাস করুন, খুব রাগ হয়। রাস্তায়-চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে শুনি, ‘বুদ্ধ-বিমান এই পুরানো মুখগুলো মানুষ আর দেখতে চাইছে না। ওদের সরানো উচিত।’ বুঝতে পারি না, পুরানো মুখগুলো কী এমন অপকর্ম করেছে। এত বছর ক্ষমতায় থেকেও কোথায় কালির দাগ লেগেছে! একদিকে তিনবছরেই একদিনের কেলেঙ্কারিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আরেকদিনের অপকর্ম, গ্রাম পঞ্চায়েত মেম্বারও দিব্যি ঘুরছেন স্করপিও বা জাইলোয় চড়ে। আর ৩৪ বছর ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও এই মানুষগুলোর জীবনযাপন কী সাধারণ।
অস্বীকার করব না, কোনও কোনও ব্যাপারে আপনার উপর রাগ বা অভিমান হত (হয়ত ভালবাসতাম বলেই হত)। কিন্তু এখন যখন প্রতিদিন নির্লজ্জ মিথ্যের বেসাতি শুনি, যখন প্রতিদিন নিচুস্তরের অসভ্যতা দেখতে হয়, তখন বুঝতে পারি, আপনি কতটা আলাদা। আপনার কথায় উঠে আসত সুস্থ রুচি, আর এখন উঠে আসে খেউড়। ওই চেয়ারে বসে দিনের পর দিন এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা যায়! যায় তো, দেখছি তো। দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছে বলেই এখন আর রাগও হয় না। কিন্তু রাজ্যের মানুষ কি এখনও বুঝছে তাঁরা কার জায়গায় কাকে বসিয়েছেন!
একটা অদ্ভুত সরলীকরণ শুনি, সিপিএম যা ছিল, এরাও তাই। একবারও মনে হয় না, এই সরকার কোনও তুলনাতেই আসে না? একবারও মনে হয় না আগের প্রশাসন অনেক বেশি সৎ ও সংবেদনশীল ছিল ? আমাদের স্মৃতিশক্তি এতই লোপ পেয়ে গেল? মাঝে মাঝে মনে হয়, বেশ হয়েছে। আমরা যেমন, ঠিক তেমন মুখ্যমন্ত্রীই পেয়েছি।
কমরেড, এ বড় সুখের সময় নয়। আগের দু বছর গ্রামে গ্রামে কর্মীরা আক্রান্ত। সে ছিল এক ভয়ঙ্কর সমস্যা। কিন্তু গত কয়েকমাসে সমস্যাটা অন্যরকম। নিরাপদ ছাতা হিসেবে সেই মানুষ ভিড়ছেন গেরুয়া শিবিরে। এই স্রোত হয়ত বাড়বে। হয়ত ধর্মীয় মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হবে। হয়ত ভোটের হার আরও কমবে। কেউ কেউ বিকৃত আনন্দে চিৎকার করবে, সিপিএম ফিনিস। কমরেড, জানি পথটা কঠিন। শরীরও আগের মতো সঙ্গ দিচ্ছে না। তবু বলব, লড়াইয়ের ময়দানেই থাকুন। মার্কেস, জীবনানন্দ, মায়াকভস্কি থাকুক। পাশাপাশি মিছিল আর আন্দোলনও থাকুক। নতুন মুখ নয়, বিশ্বস্ত মুখ হিসেবে আপনার উপরই ভরসা আছে, এখনও।
Also Check : Download Android Applications
সন্ধে নেমে আসবে। রাত গভীর হবে। টিভির দিকে চোখ রাখবেন না। নিজেকে বইয়ের পাতায় নিমগ্ন রাখুন। আর ফিরে চলুন সেই চোদ্দ বছর আগের বিকেলটায়।