অন্তরা চৌধুরি
ভুবন বাদ্যকরের কাঁচাবাদাম গান সমতলকে ছাড়িয়ে যে পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে, এতটা
আশা করিনি। ভুলটা ভাঙল কচিকাঁচাদের কণ্ঠে নেপালি ভার্সেনে সেই গান শুনে।
ছয় হাজার ছ’শো ফুট উচ্চতায় ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম রঙ্গারুন। দার্জিলিং থেকে মাত্র পনেরো কিলোমিটার। সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কয়েকটা পাকদণ্ডী পেরিয়ে ওপরে উঠতেই দেখা গেল একখানা মারুতি ভ্যানে কতকগুলো কুচো কুচো ছেলেমেয়ে স্কুল ড্রেস পরে গাড়ির ভেতরে মহানন্দে ‘কাঁচা বাদাম’ গাইছে। কেউ আবার গানের তালে একটু কোমরও দুলিয়ে নিচ্ছে। বোঝা গেল, বাকিরাও গানটার সঙ্গে পরিচিত। ওই ছেলেগুলো রবি ঠাকুরের নামও শোনেনি। বাংলা একটি বাক্যও জানে না। কিন্তু কোন যাদুমন্ত্র বলে ‘কাঁচা বাদাম’ তাদের কাছে পৌঁছে গেছে।
অধিকাংশ মানুষ দার্জিলিং বলতে শুধু দার্জিলিং শহরটাকেই বোঝেন। কিন্তু এই জেলার আনাচে কানাচে আরও কত যে পাহাড়ি গ্রাম আর অনাবিল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তার খবর আমরা কজনই বা রাখি! টাইগার হিলের ঠিক নীচে চা বাগান, ঝর্না, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অসংখ্য পাহাড়ি ফুল আর অফুরন্ত সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে আছে এই রঙ্গারুন। একান্তে এই হিমালয়কে উপভোগ করতে হলে এই গ্রামে একবার আসতেই হবে। সঙ্গে পরিবার থাকলে তো ভালই। যদিও একাও আসেন, এমন পরিবেশে নিজের মুখোমুখি বসেও ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
দার্জিলিং যাওয়ার পথে ঘুমের ঠিক আগেই জোড়বাংলো। সেখান থেকে একটা রাস্তা ডান দিকে চলে
গেছে। ঢালু পথে গাড়িতে মিনিট পনের-কুড়ি গেলেই রঙ্গারুন। জোড়বাংলোতে একপ্রস্থ মোমো, ওয়াই ওয়াই এবং চা হয়ে গেল। জোড়বাংলোর বাজার পেরিয়ে কিছুটা পথ যেতে না যেতেই গা ছমছমে প্রকৃতি একেবারে স্বমহিমায় হাজির। একেবারে আদিম অরণ্যের বুক চিরে যাওয়া বলতে যা বোঝায় তাই। কুয়াশা ঢাকা পথঘাট। বড় বড় পাইন আর ফার্ন গাছের ভেতর দিয়ে হিমেল মেঘের আনাগোনা। পাহাড়কে বরাবরই আমার খুব রহস্যময় মনে হয়। মনে হয় কী যেন এক অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে ওই আদিম অরণ্যের বুকে। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় জঙ্গলের পথ ভিজে। চারিদিকে মৃত পাতার স্তূপ। বুনো ভেষজ গন্ধের সঙ্গে মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোচ্ছে। সকাল এগারোটার সময় মনে হচ্ছে যেন রাত্রি নেমে এসেছে। চারিদিক ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রাস্তাঘাটে লোকজন একেবারেই নেই। মনে হচ্ছিল কোথাকার কোন মধ্যযুগীয় আদিম জঙ্গলে প্রবেশ করতে চলেছি কে জানে!
একটু একটু করে নীচের দিকে নামতেই রোদ্দুরের দেখা পাওয়া গেল। দূর থেকেই চোখে পড়ল পাহাড়ের কোলে ফুলে ফুলে সাজানো ছোট্ট একটা গ্রাম। গাড়ি এসে থামল বিষাণজির বাড়ির কাছে। হোমস্টেতে আগে থেকেই বলা ছিল। তিনি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আমাদের উপরে নিয়ে গেলেন। নীচের তলায় স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। একজন পরিচারিকা এসে রান্না করে দেন। ঘরের লাগোয়া একটি দোকানও রয়েছে। উপর তলাটি খুব সুন্দর ছিমছামভাবে সাজানো। চারিদিকে নেপালি সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার ছাপ স্পষ্ট। পরিপাটি করে সাজানো নেপালিদের এই ছোট ছোট কাঠের ঘরগুলি খুবই আকর্ষণীয়। জানলা খুলতেই একঝাঁক হিমালয়ান বাতাস আর তার নৈসর্গিক দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে দিল। বিষাণজির স্ত্রী ততক্ষণে আমাদের জন্য সুন্দর চৈনিক কাপে নিয়ে এসেছেন বিখ্যাত দার্জিলিং চা। তবে রুমের তুলনায় বাথরুম থেকে ভিউ আরও অসাধারণ। জানালার ওপারেই দিগন্ত বিস্তৃত চা–বাগান। এমন সবুজের সমারোহে মন সবুজ হতে বাধ্য।
তখন লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু মনে হল, খাওয়ার আগেই একপ্রস্থ হেঁটে নিলে কেমন হয়। অন্তত চারপাশের মানচিত্রটা একটু চেনা হবে। স্নান সেরে গ্রামের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। কয়েক পা যেতে না যেতেই চোখে পড়ল ছোট ছোট ঝর্না আর রোডোডেনড্রন। বর্ষার সময় এই ঝর্নাগুলোই আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। সামনেই একটা ছোট্ট দোকান রয়েছে। সেখানে কিছু ভুট্টা চকোলেট কেনা হল। দোকানী বেশ আলাপী। চারপাশে কোথায় কী আছে, কোনটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়, কোনটা গাড়িতে যেতে হবে, সব বুঝিয়ে দিলেন। বিষাণজিকে গ্রামের সকলেই চেনেন। বেশ ভালওবাসেন। বিষানজির হোমস্টে ছাড়াও এখানে আরও তিনটি হোমস্টে রয়েছে।
পাহাড়ি পথে হেঁটে বেশ ভালরকম ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখি গরমাগরম লাঞ্চ ততক্ষণে রেডি। পাহাড়ের হোম স্টে–তে একটা অলিখিত প্রথা আছে। দিনের বেলায় ডিম আর রাতে দেশি মুরগি। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য দুপুরে মাছের ব্যবস্থাও আছে। সেদিন আমাদের মেনুতে ছিল ভাত, স্যালাড, ডাল, আলুভাজা, বাঁধাকপি আর ডিমের কারি, আর পাঁপড়। মেনু আপাতভাবে সাদামাটা হলেও সেই নেপালি দিদির রান্নার গুণে হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। ফিগার কনশাসনেসকে দূরে সরিয়ে রেখে বেশ গোগ্রাসে খাওয়া হল। পাহাড়ে বেড়াতে গেলে দুপুরে বিশ্রাম নৈব নৈব চ। কারণ সন্ধের পর কোথাও যাওয়ার থাকে না। অফুরন্ত বিশ্রামের অবকাশ। তাই দুপুরটা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। ফের পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রঙ্গারুনে আসার আগে ইউটিউবে ও ফেসবুকে টুকটাক গবেষণা চালিয়েছিলাম। এখানে এসেছেন, এমন কিছু লোকের মতামতও নিয়েছিলাম। ছবিতে দেখেছিলাম হোমস্টের বারান্দা থেকেই অনেকখানি কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন এলাম, মেঘের আড়ালে তিনি মুখ লুকিয়েছেন। তাঁকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ মন থেকে মুছে ফেলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম। রাশি রাশি ফুলে ঘেরা এমন সুন্দর গ্রাম এর আগে খুব বেশি দেখিনি। সবচেয়ে অবাক হতে হয় গোলাপের বংশ বিস্তার দেখে। আমাদের সমতলে গোলাপের কত আদর। কত যত্ন করে তাকে প্রতিপালন করতে হয়। কিন্তু এখানে
দেখলাম সম্পূর্ণ অনাদরে আগাছার জঙ্গলের ভেতর ফুটে রয়েছে অজস্র গোলাপ। বিষাণজির বাড়ি থেকে কয়েক পা গেলেই একটা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুল। তাঁর তিন বছরের মিষ্টি ছেলে আরভ এখন এই স্কুলের ছাত্র। স্কুল পেরোতেই বাঁ দিকের একটা পাথুরে কাঁচা রাস্তা নীচের চা বাগানের দিকে চলে গেছে। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম চা–বাগানের রাস্তা ধরে ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলেই পাওয়া যাবে রঙ্গু নদী। সেই নদী পেরিয়েও দার্জিলিং যাওয়া যায়। ডানদিকের রাস্তাটা ধরে কয়েক পা হাঁটলেই চা ফ্যাক্টরি। কিন্তু ততক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে। অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছে যতই থাক অত বেলাতে ওইরকম পাহাড়ি পথে না যাওয়াই মঙ্গল। তাই আমরা ডান দিকের রাস্তাটা ধরেই এগোচ্ছিলাম। একটা বাঁক পেরোনোর পরই মনে হল এই রাস্তাটা যেন স্বপ্ন দিয়ে সাজানো। ওই ছোট্ট রাস্তাটুকু যে কী অপূর্ব সুন্দর তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য।
কাঁচামাটির রাস্তা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে চা ফ্যাক্টরির দিকে। রাস্তার একদিকে পাহাড়ের দেওয়াল আর অন্যদিকে চা বাগানের ঢাল নেমে গেছে নীচের দিকে। আর তারই মাঝখানে সুবিশাল কয়েকটা পাইন গাছ এই রাস্তার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর চারপাশে অফুরন্ত নাম না জানা রংবেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে। মনে হল, নির্জনে পাহাড়কে উপভোগ করার এর চেয়ে ভাল জায়গা আর হয় না। রাস্তার ওপরেই বসে পড়লাম। সামনের পাহাড়টার নাম জলাপাহাড়। ধাপে ধাপে কত মানুষের
বসতি গড়ে উঠেছে। যেখানে বসে ছিলাম তার ঠিক নীচ দিয়েই চা বাগানের ঢাল নেমে গেছে। সামনের সবুজ পাহাড় মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে ভ্যানিস যাচ্ছে। আবার মেঘ সরে গিয়ে কখনও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। মুগ্ধ হয়ে এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছিলাম।
কোথা দিয়ে যে সময় বয়ে গেল খেয়াল করিনি। দুপুর গড়িয়ে তখন একটু একটু করে বিকেল নামছে। কতদিন এমন নির্মল বিকেল দেখিনি। এমন সময় বিভিন্ন রঙের তিন চারখানা কুকুর আমাদের ওইভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেও একটু আদুরে সুরে ওদের সঙ্গে কথা বলতেই ভাব হয়ে গেল। ওরা দেখলাম লেজ নাড়তে নাড়তে আমাদের আপাদমস্তক শুঁকে নিল। সঙ্গে কোনও খাদ্যদ্রব্য না থাকায় বেচারাদের কিছু দিতেও পারলাম না। বললাম, ‘সকালে তোদের বিস্কুট খাওয়াব।’ নেপালি কুকুর কী বুঝল কে জানে! দেখলাম আমাদেরকে ছেড়ে প্রবল উৎসাহে চারজন মিলে খাদের ধারে
কী যেন একটা খুঁজে চলেছে। ভাবখানা অনেকটা বোম স্কোয়াডের সারমেয়দের মতো। জটায়ু থাকলে নির্ঘাত বলতেন, হাইলি সাসপিসিয়াস। কিন্তু ওরা কী খুঁজছে? নিষিদ্ধ কিছুর সন্ধান পেয়েছে? দেখলাম ওঁদের মধ্যে যিনি বেশ একটু হৃষ্টপুষ্ট তিনি পরিষ্কার আগাছার জঙ্গল খুঁজে সেখানেই পা তুলে সেই মহান কাজটি সেরে ফেললেন। বাকিরাও তাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁরই পথ অনুসরণ করল।
নিস্তরঙ্গ বিকেল গড়িয়ে চলেছে সন্ধের দিকে। দূরের জলাপাহাড় ও দার্জিলিংয়ে একটা দুটো করে আলো জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। ভেতরে না ঢুকে সামনের ঝুল বারান্দাতেই বসলাম। মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাসে সন্ধের চা আর পকোড়া জাস্ট জমে গেল। সেদিন বিষাণজির ভাইপো এসেছিলেন। বছর তেইশ–চব্বিশ বয়স হবে। বেশ প্রাণবন্ত। শুনলাম তিনি কলকাতায় এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। কিন্তু ম্যালেরিয়া হওয়ায় তিনি মানে মানে কলকাতাকে গুডবাই জানিয়ে গ্রামে ফিরে এসে হোমস্টে খুলে বসেছেন। সন্ধ্যেটা তার সঙ্গে গল্প করেই কেটে গেল। কথায় কথায় জানলাম একটু উপরের দিকেই রয়েছে ট্রেকার্স হাট। সেখানেও বেশ কয়েকজন অতিথিদের থাকার ব্যাবস্থা রয়েছে। দেখাশোনা তিনিই করেন। এছাড়াও অতিথিদের নিয়ে তিনি ট্রেকিং-এ যান। ওদিকে রঙ্গু নদী, এদিকে টাইগার হিল। জঙ্গলের মাঝে টেন্টে থাকা খাওয়ার বেশ রোমাঞ্চকর ব্যবস্থা।
পাহাড়ের মানুষ তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়েন। তাই আমাদেরও আটটার মধ্যে ডিনার দিয়ে দেওয়া হল। বেগুনের সবজি, ডাল, রুটি আর দেশি মুরগির ঝোল। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেসে নেই। তাই কর্তা পড়তে শুরু করল, আর আমি ডায়রি লিখতে বসলাম। রাত্রি তখন কটা বাজে খেয়াল নেই। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন প্রবল জোরে মাথার ওপরে থাকা জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়ে লাইট জ্বালালাম। কিছু পরেই ভুল ভাঙল। আসলে প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে জানালায়। আর তাতেই এই বিপত্তি। কেমন একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ। পরের দিন ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে। বিষাণজিরা তখনও ওঠেননি। আমরা একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড় বা জঙ্গলে বেড়াতে গেলে ভোরকে মিস করতে নেই। তাই কুয়াশার চাদর ভেদ করে টি ফ্যাক্টরির দিকে এগিয়ে চললাম। চা শ্রমিকরা অত ভোরবেলাতেও বেশ সেজেগুজে পিঠে ঝুড়ি নিয়ে নিজের নিজের কাজে চলেছে।
১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা এই চা বাগান ও কারখানা তৈরি করেন। ভেবে দেখুন, তখনও সিপাহী বিদ্রোহ হয়নি। তখনও রবীন্দ্রনাথ নামক মানুষটির জন্ম হয়নি। সেই তখনই শিল্পায়নের হাওয়া পৌঁছেছিল এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদে। কারখানার বহুবার হাতবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সময়ের দাবি মেনে সেই আধুনিক যন্ত্রপাতি আর উন্নত প্রযুক্তি আসেনি। তাই ব্রিটিশ আমলের এই আলুবাড়ি কারখানাটি এখন বন্ধ। ভেতরে রয়েছে ইংল্যান্ড থেকে আনা বিভিন্ন ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রপাতি। কারখানা বন্ধ হলেও বাগান চালু। শ্রমিকরা পাতা তুলে এই কারখানাতেই এনে জড়ো করেন। তারপর ট্রাকে সেই চা পাতা চলে যায় এই মালিকেরই অন্য কারখানায়। সেখানে হয় পাতা থেকে চা তৈরির কাজ।
এখান থেকেই যাওয়া যায় ম্যানেজারের পুরনো বাংলোতে, যা ১৮৬০-৭০ নাগাদ তৈরি। ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন পুরনো পেন্টিং ও অ্যান্টিক আসবাবপত্র। এর পাশেই রয়েছে একটি ক্যাথলিক চার্চ। ফিরে এসে জলখাবার খেয়ে এবার গুটি গুটি পায়ে উপরের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলাম। এটি অবশ্য পিচের সুন্দর রাস্তা। পাহাড়ের এক এক বাঁকে এক একরকম সৌন্দর্য। জঙ্গলে জঙ্গলে কত বিচিত্ররকমের যে গাছ আছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অপূর্ব তার শোভা। রংবেরঙের পাখির বিচিত্র কলতান। খুব একটা খাড়াই পথ নয়। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দিব্যি হাঁটতে থাকুন। এই পথ চলার রোমাঞ্চই আলাদা। সপ্তপদীর সেই গানটা গুনগুন করে গেয়ে উঠতেই পারেন। একান্তই যদি মনে হয়, অনেকটা দূরে চলে এসেছি, কোনও চিন্তা নেই। মাঝে মাঝেই গাড়ি চলছে। হাত তুলে ফিরতি গাড়িতে উঠে পড়ুন।
্
দুপুর নাগাদ ফিরে আসতেই বিষাণজির স্ত্রী দিলেন গুন্দ্রুক। মূলো শাককে মিহি করে কেটে একুশ দিন কৌটোর ভেতর রাখার পর তাকে রোদে শুকোতে দিতে হয়। তারপর সেই শুকিয়ে যাওয়া মূলোশাককে পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো দিয়ে স্যুপ বানাতে হয়। এই স্যুপ নাকি পেটের পক্ষে খুবই ভাল। ইসবগুলের সাবস্টিটিউট। খেতেও অসাধারণ। দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের বেরিয়ে পড়লাম চা–বাগানের অন্য এক প্রান্তে। কয়েকটা বাঁক পেরোনোর পর মনে হল আমরা যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্যে চলে এসেছি। চা বাগান, মেঘ আর সামনের সুবিশাল পাহাড় যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের আলিঙ্গন করছিল। পাহাড়ি ফুল মাথায় দিয়ে বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করা হল। কিন্তু আসল ছবিটাই বাদ থেকে গেল। তা হল কাঞ্চনজঙ্ঘা। দুই পাহাড়ের ফাঁকে একটা মস্ত রেঞ্জ। পুরো রেঞ্জটা জুড়েই দেখা যায় শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্তার। কিন্তু এই দুদিন মেঘের আড়ালে তিনি ঢাকাই থেকে গেলেন। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি আবহাওয়া ঝকঝকে থাকে। তখন রোজই অনন্ত সময় দেখা দিয়ে যান এই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু বিষাণজির মুখে শুনেছি ব্ল্যাক প্যান্থার আর হিমালয়ান লেপার্ডের গল্প। তাই সূর্য পাটে বসতেই গ্রামের রাস্তা ধরে আমরাও ফিরে এলাম। এখানকার প্রতিটি বাড়ি এবং পথঘাট এত অজস্র ফুল দিয়ে সাজানো যেন মনে হয়ে ফুলেদের দেশে চলে এসেছি। আমাদের এই বাংলা এত সুন্দর তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সন্ধ্যে নামতেই ফিরে এলাম। সেদিন মোমো বানানো হয়েছিল। চা আর মোমো খেতে খেতে বিষাণজির সঙ্গে গল্প জমে গেল।
শুনলাম ট্রেকার্স হাটটি নাকি এক বেলজিয়াম ভদ্রলোক বানিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ বেলজিয়ামের লোক এই অখ্যাত গ্রামে হোম স্টে বানাতে গেলেন কেন? আগ্রহী হয়ে ঘটনাটা জানতে চাইলাম। যা শুনলাম তা তো সিনেমাকেও হার মানায়। সেই গল্প আপাতত তোলা থাক। পাহাড়ের বুকে কত অজানা ইতিহাস, কত লোকাচার, কত ঘটনার ঘনঘটা। বিষাণজির কাছে সেসব শুনতে শুনতেই সন্ধে গড়াল রাতের দিকে। শুনলাম বিচিত্র কিছু ট্যুরিস্টদের অদ্ভুত সব আবদারের ইতিকথা। ওই দূরের পাহাড়ের আলোগুলো এক এক করে জ্বলে উঠেছে। কত তারা যেন মাটিতে নেমে এসেছে।
পরের দিন আমাদের ফেরার পালা। মানে এক ঠিকানা থেকে পাহাড়ের অন্য ঠিকানায় পাড়ি দেওয়ার কথা। আসল চমক তখনও বাকি। গাড়ি এসে গেছে। ব্যাগপত্তর তোলাও হয়ে গেছে। বিষাণজি বেরিয়ে এলেন পাহাড়ি উত্তরীয় (খাদা) নিয়ে। খাদা পরিয়ে দিলেন বিদায় অভ্যর্থনা। আমরা এসেছিলাম এই নেপালি পরিবারটির অতিথি হয়ে। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই যেন এই গ্রাম ও এই পরিবারটির আমরা আত্মীয় হয়ে গেছি। এই আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে যেতে কার আর ভাল লাগে! জীবনানন্দের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছিল, আবার আসিব ফিরে। রঙ্গারুন, আবার দেখা হবে।
(পাহাড়ের কত অচেনা জনপদ। সেই সব জায়গার কত অজানা ইতিহাস। উঠে আসুক আপনার লেখনিতে। এমনই কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসার পর সেই অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারেন পাঠকদের সঙ্গে। পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসের ঠিকানায়। bengaltimes.in@gmail.com)