বৃষ্টি চৌধুরি
বাংলা গানে বনস্পতি হয়ে ওঠার মতো প্রতিভা তাঁর ছিল। ছায়াও দিতে পারতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁকে ব্যবহার করতে পারিনি।
সে কথা থাক। আজ তাঁর জন্মদিন। বয়স হয়ে গেল ৬৮। বলাই যায়, তিনি বৃদ্ধ হলেন। তাঁর গানের প্রবাদ হয়ে ওঠা লাইন – চল্লিশ পেরোলেই চালশে। কিন্তু কতটা পথ পেরোলে তবে বৃদ্ধ বলা যায় ? প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরটা ততটা সহজ নয়।
আড়াই দশক ধরে বাংলা গানে একটা অন্য জোয়ারের নাম সুমন। বাংলা গানের চলমান এক এনসাইক্লোপিডিয়া। কীর্তন থেকে রামপ্রসাদ, টপ্পা থেকে খেয়াল, রবি ঠাকুর থেকে অতুল প্রসাদ, হীমাংশু দত্ত থেকে সলীল চৌধুরি – সর্বত্রই যেন অবাধ বিচরণ। আর নিজের তৈরি করা যুগান্তকারী গান তো আছেই। বিনিময়ে আমরা কী দিয়েছি ! তাঁর গানের ভাষাতেই বলি, ‘শোনো দারুণ উদারমনা, তুমি রাগতে রাগতে বোলো, ওই সুমন চাটুজ্যেটা শেষবেশ মুসলিম হল।’
স্বীকার করার সততা নেই। কিন্তু মূলস্রোত বাঙালির কাছে এটাই বোধ হয় তাঁর পরিচয়। চিরকাল আমরা কিছু ছেঁদো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। যাঁরা সময়ের থেকে এগিয়ে থাকেন, তাঁদের কাঁকড়ার মতো টেনে নামিয়েছি। সুমনের ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। কোথায় তিনি কী বিতর্কিত মন্তব্য করলেন, কোথায় তাঁকে ছোট করা যায়, সেই ফুরসত খুঁজেছি। বাংলা ছবিতে তাঁকে কতটুকুই বা কাজে লাগিয়েছি। সৃজিত চেষ্টা করেছিলেন। ফল পেয়েছেন। জাতিস্মর ছবিটা না চললেও, দীর্ঘদিন পর গানের জন্য কো্নও ছবি অমরত্ব পেতে চলেছে। যেটা সৃজিত পারলেন, সেটা অন্যরা পারেন না কেন ? কোনও এক অলিখিত ফতোয়া নেই তো ? সুমনকে গান গাইতে বললে, পাছে কেউ রেগে যান! না বাম, না ডান, কোনও শিবিরই তাঁকে বুঝতে পারেনি। কো্নও শিবিরই তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পারেনি।
আজ জন্মদিনে নজরুল মঞ্চে তাঁর একক অনুষ্ঠান। যাঁরা কখনও তাঁর অনুষ্ঠান দেখেননি, তাঁরা জানেন না, তাঁরা জীবনে কী মূল্যবান অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত রইলেন। এখনও সময় আছে। চাইলে চলে আসুন নজরুল মঞ্চে। ইচ্ছে থাকলে, তাগিদ থাকলে টিকিট নিশ্চয় পেয়ে যাবেন। যদি একান্তই না আসতে পারেন, চোখ রাখুন কলকাতা টিভির পর্দায়, সন্ধে ৬-৩০ থেকে। পরে নিশ্চয় রিপিট হবে। তবু সরাসরি দেখার রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হবেন না।
আড়াই দশক ধরে অনেক কাদা ছিটিয়েছি। এখন তা শুধরে নেওয়ার সময়। আসুন, দেখে যান, বাংলা গানকে নতুন করে ভালবাসুন। কবীর সুমন, আপনার কাছে জন্মদিনে কীই বা চাইব ! না বুঝে যাঁরা ব্যর্থ নমস্কারে আপনাকে ফেরালো, সেই অর্বাচীনদের ক্ষমা করুন। এই দীনতা, এই ম্লানতা ক্ষমা করুন। জন্মদিনে এটুকুই প্রার্থনা।