আড়ালে থাকা মাটির কবি বিনোদ বেরা

মেদিনীপুরের এক ছোট্ট গাঁয়ের এক সরল শিশুর গল্প ,প্রথম জীবনে পড়তে না জানা এক নিরক্ষরের কবি হয়ে ওঠার গল্প ,আজীবন হাল ধরা এক কৃষকের গল্প ,জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় যার লেখনীতে বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত বার বার ফিরে এসেছে যার কবিতা সমকালীন কাব্য জগতকে এক আলাদা মাত্রা দান করেছে সেই মাটির কবি বিনোদ বেরার নানান অজানা কাহিনি …………….
_ শোভন চন্দ ও অয়ন দাস

ডেরা গাঁয়ের ছোট্ট বিনোদ

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরের দীঘা উপকূলবর্তী ডেরা নামের ছোট্ট একটি গ্রামেতিনি জন্মগ্রহণ করেন। সদ্যজাত অবস্থায় ছেলেটি তার বাবাকে হারায় ,কিছু কাল পরে মা- ও মারা যান, মায়ের মুখটাও ঠিক করে মনে নেই তার। জ্যাঠাইমা ও পরিবারের অন্যদের কাছে ধীরে ধীরে বড়োহয়ে ওঠে ছোট্ট বিনোদ । বয়স তখন এগারো বারো অন্য ছেলেরা স্কুলে যায় লেখা পড়া শেখে কিন্তুবিনোদের লেখা পড়া শেখা হয়ে ওঠেনি ।সে লিখতে পারেনা অন্য ছেলেদের মতো পড়তেও পারেনা ।

একদিন এক মজার ঘটনা ঘটে,সেই থেকে ছেলেটির জীবনে যেন সব কিছু বদলে যায়।একদিন পাড়ায় একটি নেমন্তন্ন বাড়িতে সে যায়। সেখানে একজন মহাভারত সুর করে পড়ছিলেন আর ছোট্ট বিনোদঅভিমন্যু বধের সেই বেদনাদায়ক কাহিনি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিল। তারপর মহাভারত পড়াবন্ধ হয়ে যায়, নেমন্তন্ন বাড়িতে খাওয়াদাওয়া শুরু হয়ে যায় ।কিন্তু বিনোদের মন পড়ে থাকে মহাভারতের সেই কাহিনিতে।এর পর কি হল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কৌতূহলস্পৃহায় সে অস্থিরহয়ে উঠল। আবার একটি ঘটনা ঘটল, তার বাড়িতে কয়েকজন ছেলে পড়তে থাকত ওরা একদিন একগল্প পড়ছিল সেই গল্পের সীতারাম নামের এক চরিত্র বিনোদের ভালো লাগে সে সীতারম সম্পর্কে জানতেচায়। জানার এই তাগিদ তাকে ক্রমেই বিব্রত করে তোলে ।ছেলেগুলি স্কুলে চলে গেলে সে ওই বইটা খুঁজেবের করার চেষ্টা করে কিন্তু পায়নি । অন্যের বাড়িতে সারাদিন মাটি কুপিয়ে দশ টাকা রোজগার করেএকটি মহাভারত কেনে। পরে অনেক কষ্ট করে সে এক লাইব্রেরীর সন্ধান পায়। পাড়ারই এক ছেলেকে জোগাড় করে তাকে একটি খেলার মার্বেল দিয়ে তার সাথে লাইব্রেরীতে এসে পৌঁছয় ।

binod bera

এই প্রথম বার সে চোখের সামনে এত বই দেখতে পায় তারপর লাইব্রেরী থেকে চন্দ্রশেখর নামের একটিবই নেয়, কিন্তু বই নেওয়ার সময় সে নিজের নাম সই করতে পারছেনা সেই লাইব্রেরীর মাস্টার মশাইতার হাত ধরে তাকে নাম সই করা শেখান।বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেই বই ঠিক করে পড়তেও পারে না বিনোদ । পড়ার অদম্যস্পৃহায় ধীরে ধীরে সে বর্ণ চিনতে শুরু করে, প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ পড়ে লাইব্রেরীর মাস্টার মশাইয়ের শেখানোনিজের নাম মাটির দেওয়ালে নখ দিয়ে অভ্যাস করতে থাকে , ধীরে ধীরে বই পড়ার নেশা ধরে যায় বিনোদের। বইয়ের দোকানে বসে বসে বই পড়তে শুরু করে।একটি বই একদিনের মধ্যে শেষ করে আবার পরের দিন হাজির হলেন লাইব্রেরীতে মাস্টার মশাই বিরক্তহয়ে তাকে একসাথে একাধিক বই নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ রবীন্দ্রনাথ একের পর এক পড়তে থাকলেন পড়ার সাথে সাথে লেখার প্রয়োজন অনুভব করলেন। ফেলে দেওয়া ছেঁড়া কাগজে নিজের ভাবনাগুলোকে লিখতে শুরু করলেন। সাহিত্য পড়া শুরু করলেন ছন্দকে জানার চেষ্টা করলেন।
ইতিমধ্যে তৎকালীন কাঁথি কলেজের অধ্যাপক অমূল্য কুমার দাশগুপ্তের সঙ্গে তরুণ বিনোদের আলাপ হয় । অমূল্য কুমার দাশগুপ্ত তখন শনিবারের চিঠি পত্রিকায় লিখতেন। তিনি বিনোদকে বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী,বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত , জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য কবিদের কথা বলেন । অমূল্যবাবু তার লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন ।
এমন সময় ঘটল এক মজার ঘটনা কাঁথির ময়দানে এক সমাবেশে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন। আপন লেখনীগুনে ইতিমধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। সমাবেশের সাথে যুক্ত এক পরিচিতকে ধরে তরুণ বিনোদ ব্যারিকেড ভেঙে দেখা করলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তারাশঙ্করের সাথে দেখা করে তিনি তাকে তার বই পড়ার কথা জানালেন, নিজের লেখার কথাও বললেন । সব শোনার পরে তারাশঙ্কর তাকে বললেন সাতদিন তিনি যা ভাববেন তা লিপিবদ্ধ করে তাকে লেখা পাঠাতে, ঠিকানাও দিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তখন টালা পার্কে থাকতেন। কিন্তু পাঠানো লেখা অনেক বার ফিরে আসে। এমন সময় বিনোদ আনন্দবাজার পড়ে জানতে পারলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মস্কোতে এবং পত্রিকায় তার ফিরে আসার কথাও পড়লেন তারপর অনেক চেষ্টার পর সেই লেখা তারাশঙ্করের কাছে পৌঁছয় । তারাশঙ্কর সে লেখার প্রশংসা করলেন ।
এরপর বিনোদের জীবন একটি ঘটনা ঘটে যা তার জীবনকে নতুন দিশা দেয় । তৎকালীন সময়ে কলকাতায় সিটি কলেজের অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ।সেই কলেজের ছাত্ররা বিনোদের পরিচিত ছিল। তারা পুজোর সময় হাতে লেখা শিখা নামে একটি পুজোসংখ্যা বের করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই পত্রিকায় বিনোদকে লেখা পাঠানোর কথা বলা হয়। বিনোদ রাজি হয় কিন্তু লিখতে গিয়ে এক নতুন সমস্যা শুরু হয়। সে অনুভব করে তার লেখা আসছে না ,কবিতা আসছে না। ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি খুব রাগ হতে থাকে অবশেষে একটি গদ্য রচনা করলেন পরবর্তী সময়ে শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত হল প্রথম লেখা “ধূলিবাসর “ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লেখাটির খুব প্রশংসা করলেন। শুরু হল বিনোদের সাহিত্য রচনার যাত্রা । তারপর তিনি পাড়ি দিলেন কলকাতায় ।

(কলকাতায় পরবর্তী জীবনটা ঠিক কেমন ছিল? কীভাবে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে মেলে ধরলেন গ্রামের কবি বিনোদ বেরা ? পড়ুন পরবর্তী কিস্তিতে। লিখেছেন শোভন চন্দ ও অয়ন দাসের কলমে। )

amazon-giftsoflove

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.