সুগত রায়মজুমদার
গত লোকসভা নির্বাচনের মতো আগামী পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের হার অনিবার্যই থাকবে। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, গত লোকসভা নির্বাচনেই বহু অভিজ্ঞতা–সমৃদ্ধ তৃণমূলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি অনুমান করেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনে ফল ভাল হবে না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর দলের বহু লোকাল নেতা উন্নয়নের নামে বহু টাকাপয়সা আত্মসাৎ করেছেন মানুষের কাছ থেকে। সেজন্যই পুরো লোকসভা নির্বাচনেই তিনি নিরলস পরিশ্রমের বিনিময়ে দিনের পর দিন রোজ ৩–৪টি করে মিটিং করেছিলেন। তিনি কাউকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি। সেজন্যই নিজে ঝাঁপিয়েছিলেন ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য। সেজন্যই তিনি এবারের লোকসভা ভোটের সভায় বলেছিলেন, ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’টা আসন পাবই। তা হয়নি। তা হওয়ার কথাও নয়।
তিনি এবারের নির্বাচনে বেশ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি সভায় সভায় তাঁর নীতি–বিরুদ্ধ প্রচার করেছিলেন। তিনি মূলত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু নির্বাচনে বিজেপি–র প্রচারের চাপে সম্প্রদায়গত রাজনীতির আশ্রয় নিয়েও প্রচার করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, হিন্দুভোটে বিজেপি বেশ বড় থাবা বসাবে। সেই ভয়ে ভীত হয়েই তিনি মুসলিম–প্রধান জায়গায় বিরোধী প্রার্থীদের আর এস এস যোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচার করেছিলেন। এর ফলও তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন। সংখ্যালঘু ভোট তিনি পেয়েছেন ঠিকই, কিন্ত হিন্দু–প্রধান অঞ্চলে হিন্দু ভোট কম পেয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু শিক্ষিত মুসলিম ভোটও তাঁর দিকে না গিয়ে বামপন্থীদের দিকেই গেছে। ফলে ভোটটা মসৃণভাবে বিভাজন হয়েছে। তিনি যদি পরিষ্কারভাবে শুধু উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে ভোট চাইতেন, তা হলে মানুষ নির্দ্বিধায় তাঁকেই ভোট দিয়ে জেতাতেন। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। উন্নয়নের দিকে ছোটেননি। বরং এই ফলের জন্য সিপিএমকেই দায়ী করছেন। যদিও কে কাকে ভোট কাকে দেবেন, সেটা পুরো ব্যক্তিগত গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা ভোটারের নিজের ব্যাপার।
গত ২০১১ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা তিনি স্মরণ করতে পারতেন। তখন সিপিএমের অপশাসনের জন্য বহু সিপিএম সমর্থকের ভোট দলের প্রতি বিরক্ত হয়ে দলকে শাস্তি দিতে তৃণমূলকেই সমর্থন করেছিলেন। এজন্য সিপিএম কোনও সময় দলের সমর্থকদের ওপর দোষারোপ করেনি। তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তাঁদের ভুলের জন্যই জনসাধারণ সিপিএমকে ভোট না দিয়ে তৃণমূলকে দিয়ে জিতিয়েছিল। এটাই বাস্তব। এই ঘটনা থেকেই তাঁর তথা মমতা ব্যানার্জির শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। সেটা তিনি নেননি। বরং গত পঞ্চায়েত ভোটে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে পঞ্চায়েতগুলিকে বিরোধীশূন্য করতে চেয়েছিলেন। এর ফলও এখন তিনি পাচ্ছেন।
সাধারণ মানু্ষের চাহিদা খুব বেশি নয়। তাঁরা চান, প্রথমে গণতান্ত্রিক অধিকার, তার পর কর্মসংস্থান ও জিনিসপত্রের ন্যায্য মূল্য। সেই গণতন্ত্রকেই যদি তিনি কেড়ে নেন, তা হলে তাঁর দলকে কেন মানুষ ভোট দেবেন? এই লোকসভা নির্বাচন নিয়ে তাঁর কখনই সিপিএমকে দোষারোপ করা উচিত নয়। সিপিএম তথাকথিত বামপন্থী দল হলেও তাঁরা সঠিক পথ নিয়েছিল রাজ্যের শাসকদলকে হারাতে। তৃণমূল হলেও সেই একই পথই নিত। তাতে কে বিজেপি, কে কংগ্রেস— এটা দেখত না। একসময় তৃণমূলের সমর্থকরাও তো বিজেপি–কে ভোট দিয়ে বিজেপি–কে এনেছিল এদেশর শাসনে। বিরোধী দলগুলি সঠিক সিদ্ধান্তই নেয়। সেজন্য সিপিএমও কোনও অন্যায় করেনি। পরবর্তীকালেও সিপিএম একই সিদ্ধান্ত নেবে সামনের পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের সময়। কংগ্রেসও হয়তো এই সিদ্ধান্তই নেবে তৃণমূলকে হটানোর জন্য। এটা কোনও অন্যায় নয়।
পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও তৃণমূলের হার অব্যাহতই থাকবে। তিনি যতই উন্নয়নের বার্তাই দেন না কেন। পূর্ব নির্ধারিত পথেই সিপিএম ও সাধারণ মানুষ চলবে এই গণতন্ত্র–হরণকারী দলকে রাজ্য থেকে উচ্ছেদ করতে।
এ ছাড়াও কাটমানি ইস্যুতে সাধারণ মানুষ তৃণমূলের নেতাদের ওপর এতটাই বিরক্ত যে, অঞ্চলে অঞ্চলে তৃণমূলের সমর্থকরা প্রায় বিলীন হতে চলেছে। এর জন্য কোনও দলই দায়ী নয়। তাঁদের কার্যকলাপের জন্যই মানুষ বিরক্ত হয়ে
তৃণমূলকে ত্যাগ করতে চাইছে। ইতিহাসও তাই বলে। অতীতে আমরা ইন্দিরা গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তম নেত্রীকে হার স্বীকার করতে দেখেছি। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
কাটমানির ব্যাপারে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত বিরক্ত। যদি তিনি আরও আগে সচেতন হতেন, তা হলে লোকসভার এই শোচনীয় ফলকে হয়তো কিছুটা আটকানো যেত। এখন সাধারণ মানুষ তাঁর ‘নিজেকে সততার’ প্রচারকে কোনও গুরুত্ব দেবেন না। তাঁদের সিদ্ধান্ত পূর্ব–নির্ধারিত।