‌মমতার ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ প্রচারে বিভ্রান্ত কংগ্রেস ও সিপিএম

সুগত রায়মজুমদার
‌এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের যে ৪২টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে, তা ঘিরে এবার তৃণমূলনেত্রী ঘোষণা করেছেন, ‘এবার আমরা ৪২টি আসন পাবই এবং লোকসভায় একটি নিয়ন্ত্রক শক্তি হব। যে জোট সরকার হতে চলেছে, তাকে নিয়ন্ত্রিত করব আমরাই।’ মমতা ব্যানার্জি বুঝেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে এক বিরাট শক্তি হয়ে দাঁড়াতে চলেছে বিজেপি। সেজন্যই তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশই’ পাব। এই কথাটি শুনে বিরোধী দল সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি আশঙ্কিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তৃণমূলকে আটকাতে। মমতা জানেন, এবার আর পঞ্চায়েতের মতো নির্বাচন করানো যাবে না। কারণ এবারের লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন অনেক বেশি সক্রিয়।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘটনা সারা দেশে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সেজন্য নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত সক্রিয়। এবারের নির্বাচনে আধা সামরিক বাহিনী ও বিএসএফ বাহিনী দিয়ে ভোট হবে। ইতিমধ্যে বাহিনী রাজ্যের সমস্ত এলাকায় টহল দিচ্ছে। বিরোধীদেরও আশা, এবারের নির্বাচন পঞ্চায়েত ভোটের মতো হবে না। সুতরাং ভোট যদি নির্বিঘ্নে ও সাধারণ মানু্য যদি নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন, তা হলে তৃণমূলের কিছু আসন হাতছাড়া হবেই। এতেই আশঙ্কা তৈরি হয় তৃণমূলের। সেজন্য মমতা ব্যানার্জি গোয়েবলস নীতিকে অবলম্বন করে ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ কথাটি সারা রাজ্যে ও সারা দেশে প্রচার করে ছড়িয়ে দেন। এটাই তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। এতেই তৈরি হয় কৌশল। বিরোধীরা উদ্বিগ্ন হয়, তা হলে কি তৃণমূল এ রাজ্যে ৪২টি আসনই পাবে? এই ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয় সিপিএম ও কংগ্রেস। সেজন্য কংগ্রেস ও সিপিএম নিজেদের জোটের আশায় জল ঢেলে দিয়ে জোটে জট সৃষ্টি করে।

vote6
জোট না হওয়ায় সিপিএমের ভোট সিপিএমের বাক্সেই পড়বে। কংগ্রেসের ভোট কংগ্রেসের বাক্সেই যাবে। জোট না করে সিপিএম ও কংগ্রেস বুঝতে পারবে, তারা কত ভোট পেতে পারে। তবে এই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, সিপিএমের ও কংগ্রেসের বেশ কিছু ভোটার তৃণমূলকে হটানোর জন্য বিজেপি-কেই বেছে নিতে পারে। তা হলে বিজেপি কিছু আসন পেয়ে যেতে পারে। এটাই এবারের নির্বাচনের সমীকরণ। কংগ্রেস ও সিপিএম নির্বাচনে বুঝতে পারবে, কতটা ভোট নিজেদের নিজেদের পক্ষে, সেটা নিশ্চিত হবে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে দু-দলই ভুল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে। তখন তারা কীভাবে কার সঙ্গে জোটে যাবে, তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। জোট না হওয়ায় বিজেপি–ও যতটা আশা করেছিল, তা পাবে না। বরং তৃণমূলই কিছুটা লাভবান হবে। ভোটটা চার ভাগ হওয়ায় বেশি সুবিধা পাবে তৃণমূলই। সুবিধা পাবেকিছুটা বিজেপি-ও। কারণ ভোটটা চার ভাগ হওয়ায় তৃণমূল বেশ কিছু আসনে হার এড়াতে পারবে। আর বিজেপি কয়েকটি আসনে জেতা জায়গা থেকে ছিটকে যেতে পারে। তবে বিজেপিও কয়েকটা পেতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই মমতা ব্যানার্জি ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ কথাটি লোকের মধ্যে বারবার প্রচার করছেন। যাতে এই শব্দটি মানুষের মধ্যে গেঁথে যায়। এতেই বিভ্রান্ত হয় সিপিএম ও কংগ্রেস। সেজন্য দুই দল নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জোট গড়তে। কিন্তু তারা জোটকে জটে পরিণত করল বিভ্রান্ত হয়েই। এতে বহু বিরোধী সমর্থক নির্বাচনে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন। তাতে তৃণমূলেরই লাভ হবে। কংগ্রেস ও সিপিএম দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থেকে মানুষ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। তৃণমূলকে হটানোর এত ভাল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেটি হেলায় হারাল দুই দল। এই দুই দলের অনুমানশক্তিও হারিয়ে গেছে। ফলে লাভবান হবে তৃণমূল ও কিছুটা বিজেপি।

vote7
কংগ্রেস ও সিপিএম জোটবদ্ধ না হয়ে ৪টি দলের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। নির্বাচনের পরে কংগ্রেস আর সিপিএম বুঝতে পারবে, কী ভুল তারা করেছে। জোট হলে হয়তো তাদের পকেটে কিছু আসনও যেতে পারত। কারণ ভোটটা এক জায়গায় যেত। লাভ হত তাদের। যা থেকে তারা বঞ্চিত হল নিজেদের বিবাদের জেরে। এই জোট হলে তৃণমূল ও বিজেপি আরও কয়েকটি আসন হারাত। জোট হলে তৃণমূলের আরও ক্ষতি হত। জোট হলে বিজেপি-ও কিছু আসন পাওয়ার সুযোগ পেত না।মমতা ব্যানার্জি ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ গোয়েবেলস নীতি প্রয়োগ করেই নিজের ক্ষমতার অনেকটাই ধরে রাখতে পারবেন এই দুটি বিরোধী দলের জন্যই। এই দুটি দল মমতার চালে পা দিয়ে কি ভুল করেছে, তা নির্বাচনের ফল বেরোলেই বুঝতে পারবে। প্রথমে এই দুটি দলের উদ্দেশ্য ছিল, দুই দলের ভোট ভাগ না করে এক জায়গায় নিয়ে আসলে তৃণমূল ধাক্কা খেতে পারে। দুটি দলই ভাবে, তৃণমূলই তাদের প্রধান শত্রু। বিজেপি নয়। দুই দলই ভেবেছে, বিজেপি যদি কিছু আসন পেয়েই যায়, যায়–আসে না। তারা বিভ্রান্ত হয়ে জোট না করে নিজেদের আরও দুর্বল করে দিল। দুটি দলই নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় না থেকে ভুল পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
অতীতে ২০১৬–র লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূল দলটি সারদা ও নারদায় পিষ্ট হবে ভেবে সিপিএম ও কংগ্রেস খুব আনন্দিত হয়েছিল। তারা সেবার জোট করেও ভাল ফল করতে পারেনি নিজেদের বিশ্বস্ততার জায়গায় না আনতে পেরে। সেবার যেভাবে দুই দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিল নারদা–সারদা নিয়ে, এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূলের প্রতি সহানুভূতি বেড়ে যায়। এজন্য ফলও তৃণমূলের পক্ষেই গেছে। এবারও বিজেপি দ্বারা কিছুটা ধাক্কা খেলেও তৃণমূল মূলত ক্ষতি অনেকটাই সামলে নিতে পারবে বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিএমের জন্যই।
সিপিএমের এখন কোনও থিঙ্কট্যাঙ্ক নেই এ রাজ্যে। সিপিএমের অনিল বিশ্বাসের প্রয়াণের পর একরকম বিধ্বস্ত ও অবিন্যস্ত হয়ে গেছে এ রাজ্যে। তারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকেও দিনের পর দিন উপেক্ষাই করে চলেছে। এর ফল হাতেনাতে পেতে চলেছে সিপিএম। এই ভুল নীতির জন্য হয়তো সিপিএম এ রাজ্যে একটিও আসন না–ও পেতে পারে। তবে ভোটের শতাংশের দিক থেকে কংগ্রেস থেকে অনেকটাই েগিয়ে থাকবে। যা বিধানসভা নির্বাচনে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করবে। আর কংগ্রেস নিজেদের লোভ সংবরণ না করতে পেরে আবার আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত। কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের ব্যক্তিত্বের অভাবেই তারা এই হতাশজনক ফল করতে পারে এই রাজ্যে। তিনি কোনও দৃঢ় সিদ্ধান্তেই আসতে পারেননি। তাঁর জোটের ইচ্ছে থাকলেও পারলেন না দলকে ঠিক জায়গায় আনতে। রাজনীতিতে এ রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি ও বিজেপি কংগ্রেস ও সিপিএমকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। এটা জোটের জটের জন্যই সম্ভব হবে। আর নির্বাচন গেলে আবারও দুটি দল খারাপ ফলের জন্য তৃণমূলকে দোষারোপ করবে কীভাবে? এটাই এখন দুই দলের কাছে পরম্পরা বিপদ হয়ে থাকবে।

(‌এটি ওপেন ফোরামের লেখা। মতামত ও বিশ্লেষণ একান্তই লেখকের। বেঙ্গল টাইমসে খোলা মনেই নানা মতের সমাহার থাকে। এটিও তেমনই একটি। চাইলে, পাঠকরাও লোকসভা ভোট সংক্রান্ত নিজের বিশ্লেষণ ও মতামত পাঠাতে পারেন। তবে রুচি ও শালীনতা বজায় রেখে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা:‌ bengaltimes.in@gmail.com)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.