ভ্রমণ: সাগর ডাকে আয়

শান্তনু দেশাই

ঘোলাটে আকাশে নক্ষত্র গুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। তাদের দিকে ফোকাস করে ট্রাইপডে ক্যামেরা সেট করে একটা মিনি গোল্ড ফ্লেক ধরাল ঈশান। কিঙ্কিনিকে খুব মনে পড়ে আজকাল। কাজে মন বসে না। তাই গতকাল বিকেলে ট্রেন ধরে কাঁথিতে নেমে চাউলখোলা হয়ে এই বগুরানে এসেছে। দিঘা থেকে বেশ কিছুটা আগেই। সমুদ্র আর নদীর মেল বন্ধন এই জাগাটা। ঢেউ খেলানো বালিয়াড়ির পাশে দীর্ঘ ঝাউ বনের সারি। তারও পরে ইতস্তত কাঁটা বাবলার গাছ। জেলেদের নৌকা, দু–‌চারটে ত্রিপল দেওয়া অস্থায়ী ছাউনি। আর দূরে দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ আর ঢেউ গোনার অবসর।

ক্লিক আওয়াজ হতেই ঈশান ক্যামেরা স্ক্রিনে এক ঝলক দেখে নেয়। নাহ, আজ ঠিক নক্ষত্র মালা আসছে না। সব যন্ত্র যত্ন করে কাঁধে চাপিয়ে আশ্রমের দিকে পা বাড়াল। মোহনার কাছেই এক রামকৃষ্ণ মিশন। আবাসিক মোটে একুশ জন। মহারাজ একাই সবকিছু সামলান। দু–‌তিনটি ঘর বাইরের অতিথিদের জন্য রাখা। নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা।

ঈশানের চমৎকার লেগেছে। ছাদের দিকে মুখ করে জানালায় বসলে দামাল নোনা বাতাস এসে লাগে। দূর পারে জেলেরা যখন ডিঙ্গি নিয়ে মাছ ধরতে যায়, সকালের নরম সোনালি আলোয় এক মায়াবি জগত সৃষ্টি হয়।
ঈশান, একটু চা হবে নাকি?
মহারাজ, আসুন আসুন।
আরে থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না। তারপর, কেমন লাগলো এই জায়গা?
খুব খুব সুন্দর মহারাজ। আমি এই নিরিবিলি প্রকৃতি খুব ভালবাসি। ওই সমুদ্রের ঢেউ এর পর ঢেউ তাতে পড়ন্ত সূর্যের রঙিন ঝিলমিল আলো।
আচ্ছা মহারাজ, একটি কৌতূহল রয়েছে। যদি বলেন
কী বলত?
আশ্রমের প্রার্থনা কক্ষে পরমহংস, সারদা মা, স্বামিজির পাশে আর একজনের ছবি রয়েছে। আপনারা সকলেই বেশ আবেগপ্লুত সেই ছবিটি ঘিরে। এর কোনও বিশেষ কারণ?
ও আচ্ছা আচ্ছা। উনি নমস্য, পীতাম্বর বাবু। পীতাম্বর সান্যাল। এই যে আশ্রমটির জায়গা, বই, আসবাবপত্র সব তাঁর দান।
না ওনার কী করে বলি!
ওনার বন্ধুর। সে এক আশ্চর্য কাহিনি। শুনবে তুমি ?
অবশ্যই।
তাহলে চল দুটো মাদুর নিয়ে সমুদ্র পাড়ে।
আরে লজ্জা কর না, তোমার সিগারেট প্যাকেট তুমি নাও।
দুজনে বেশ কিছুটা হেঁটে পাড়ে গিয়ে বসল। ভাঁটা চলছে। সমুদ্র অনেকটা পিছয়ে গিয়েছে। ঢেউ এর শব্দ আসছে অল্প। সেই গুরু গম্ভীর গর্জন নেই। এ যেন সেই কাম ক্রোধ মোহ থেকে নির্লিপ্ত এক সন্ন্যাসী।
হাওয়ায় ঝাউ বনে, বাবলা বনে ফিসফিস। কত সুখ দুঃখের কথা বলে চলেছে যেন।
এই রকম এক সন্ধ্যায় পীতাম্বর বাবু ও শঙ্কর বাবু এসে বসেছিলেন এইখানে। পীতাম্বরবাবু শঙ্কর বাবুর থেকে বয়সে অনেকটা ছোট। কিন্তু পছন্দ দুজনের একই হওয়াতে মিল হতে বেশি সময় লাগেনি। পীতাম্বর একটু ভবঘুরে স্বভাবের। কোথায় কখন চলে যান কেউ জানতেও পারে না। হঠাৎ কদিন হয়ত দেখা গেল শঙ্কর বাবুর ফাটল ধরা নোনা দেওালের ঘরে তাঁর পায়ের কাছে বসে বাইরের দুনিয়ার গল্প বলে শোনাচ্ছে।
ও জেনে রেখ, শেষ বয়সে শঙ্কর বাবুর বাম দিকটা সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আর ছানি পড়ে দুই চোখ প্রায় অন্ধকার। তার ছেলে ছিল একটি। কিন্তু এই দিঘার সমুদ্রে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসে তলিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে শঙ্করবাবু ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলেন। সুলতা দেবী, শঙ্করবাবুর স্ত্রী অনেকবার স্বামীকে বলেছিলেন ,
‘‌চল তো আমাকে একবার দিঘায় বেড়াতে। কত সাহস সেই জল দানবের দেখে আসি যে আমাদের কোল খালি করে এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারে।’‌
কী দেখবে গিয়ে সুলতা, সমুদ্র তার মতো থাকে। তুমি তাকে কীভাবে নিচ্ছ, তাতে তার কিছুই এসে যায় না। তোমার জিনিস তোমাকেই ফিরিয়ে দেবে। আমাদেরও দিয়েছিল। ফারাক শুধু নীলের বুকের ধুকপুকুনিটা ছিল না।
—না না, তুমি এমন বল না। আমাকে একবার নিয়ে চল।
স্ত্রীর আবদার মেটাতে পারেননি শঙ্কর বাবু। তার আগেই ঘুমের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেল সুলতা। তারপর থেকেই একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন শঙ্করবাবু।
মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টাটিভের কাজে একটা ঘর ভাড়ার জন্য এসেছিলেন পীতাম্বর। তারপর থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। সকালে দেরি করে বেরালে পীতাম্বর একটু বেশি করে চাল ডাল করে নিতেন। দুপুরে খাওার পর রাতে অল্প কিছু ভাজাভুজি দিয়ে সেরে নিতেন রাতের আহার। আর শুনতেন শঙ্করবাবুর কাহিনি। নিজেরও কাহিনিও বলতেন। রাত্রে ফিরতে দেরি হলে দেখতেন শঙ্করবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে আলু সেদ্ধ করে পিয়াজ ভাজা দিয়ে মাখছেন।
সেই বর্ষায় শঙ্করবাবু বেশ অসুস্থ। পীতাম্বর বেশ কদিন অফিস যাননি।
একদিন শঙ্করবাবু পীতাম্বরকে ডেকে বললেন, ভাই আমাকে একটু কষ্ট করে দিঘা নিয়ে যাবি। বাবু আমাকে ডাকছে। আর এই চোখে একেবারে অন্ধকার হওয়ার আগে একটু দেখি রে তোর বউদির জল দানবকে।
পীতাম্বর দিঘায় না গিয়ে এসেছিলেন এই বগুরানে। তখন আরও নিরিবিলি আর জঙ্গল ছিল এখানে। ওই দূরে জেলে বস্তি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ওইখানেই নাকি শঙ্কর বাবুর বিঘে খানেক জমি ছিল। এক জন শঙ্কর বাবুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় দেখাশোনা করত। তার বাড়িতে হুইল চেয়ারে করে শঙ্কর বাবুকে নিয়ে এসেছিল পীতাম্বর।
সকাল বিকেল সমুদ্রের পাড়েই হুইল চেয়ারে বসে থাকতেন শঙ্কর। বিড় বিড় করে কী যে বলতেন। অভিমান, কান্না সব একসাথে বোবা করে দিত হয়ত ।

একদিন বিকেলে খোঁজ খোঁজ রব। পীতাম্বর বাজারে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে হতবাক হয়ে গেলেন। হুইল চেয়ার নিয়ে একা একা শঙ্করবাবু কোথায় চলে গেলেন?

এদিক ওদিক খুঁজেও পাওয়া গেল না। কাঁথি থানায় খবর দেওয়া হল। সারা রাত পীতাম্বর হন্যে হয়ে বালু তট, ঝাউ বন, নৌকার গলুই সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। ক্লান্ত অবসন্ন্ হয়ে বালিয়াড়িতেই ত্রিপলের ছাওয়ায় শুয়ে পড়েছিলেন। খুব ভোরে জেলেদের চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন।

একটা লাশ। কার!
পড়িমরি করে দৌড়ে গেলেন পীতাম্বর।
এই তো শঙ্কর। হুইল চেয়ারে যেমনটি বসে থাকে, তেমনই আছেন। ধুতির খুট দিয়ে পা টা বেঁধে রেখেছেন। মুখে যন্ত্রণার লেশ মাত্র নেই। স্মিত হাসি অধর প্রান্তে। শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। এত সহজ, নির্লিপ্ত যেন নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছেন সাগরের নীলিমায় নিজের নীলকে পেতে। চৈতন্য মহাপ্রভুও বোধ হয় এমনই করেছিলেন।

পুলিশ সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পীতাম্বরের জিম্মায় দেহ তুলে দেয়। আর হাতে এক টুকরো প্লাস্টিকে মোড়া কাগজ।
কিছু লেখা জলে ঈষৎ ধুয়ে হাল্কা হয়ে গেছে।
প্রিয় পীতাম্বর, অনেকদিন আগেই আমি মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।
নীল, তোমার বউদি, যেদিন চলে গেল সেদিন থেকেই। শরীরের কলকব্জা চললেও মন যদি মরে যায় সে তো সেই মৃত। আমার সেই মৃতপ্রায় মনে তুমি যে আনন্দ, যে অনুভুতির চারা রোপণ করেছিলে তার তুলনা নেই। আজ আমি ভীষণ খুশি। তুমি তো জানো, বিরহেই মিলনের আনন্দ। তোমাকে একলা ফেলে যেতে আমার কষ্ট হচ্ছে বইকি। কিন্তু এই জড়বৎ নশ্বর দেহ রাখতে চাইছিলাম না। মনে একটু হিংসেও হচ্ছিল তোমার বউদির কথা ভেবে। কেমন নীলের সঙ্গে আরামসে আছে। তাই…
যাই হোক। আমার নামে থাকা এই ছাউলখোলা মৌজায় দুই বিঘা জমি তোমাকে দান করলাম। আমার বসত বাটি বিক্রি করে দিও। বাকি সব তোমার ।

পীতাম্বর হাউ হাউ করে কেঁদেই যাচ্ছিলেন।
বিকেলে বালু তটে দাহ করে ফিরে এসে পীতাম্বর এসেছিলেন আমার কাছে। আমি তখন আমার ভিটেতেই গুরুদেবের আশীর্বাদ নিয়ে দু তিনটে বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে নিয়ে আছি। পীতাম্বরবাবু আশ্রম তৈরির জমি দান করলেন। শঙ্করবাবুর বসত বাটি বিক্রি করে টাকা পয়সা দিয়ে আটচালা এই মন্দির নির্মাণ করালেন। তাঁকে যেন কাজের নেশায় পেয়েছিল।
তাঁর শরীরও ভগ্ন হচ্ছিল। তারপর একদিন কোথায় চলে গেলেন।
মাস খানেক বাদে ফিরে এলেন। খুব রুগ্ন শরীর নিয়ে। আমাকে বললেন, মহারাজ আমিও যাব আমার বন্ধুর কাছে। বড্ড মন খারাপ করছে। মাথা ধরে থাকে। কিছুই ভাল লাগে না।
ডাক্তার দেখানো হল। গুরু মহারাজ অনেক বোঝালেন। তাঁর সেই এক গোঁ, বন্ধুকে বেড়াতে যাওয়ার গল্প শোনাতে হবে। অনেকদিন হল একসঙ্গে বসিনি।
মহারাজ, আমার শরীর আমি দান করে যাচ্ছি। যেটুকু কাজে লাগে। এই বলে সেই ঝাউ বনে ভাঙা নৌকার গলুইয়ে বসে রাত কাটিয়ে দিলেন।
তারপর বেশিদিন থাকেননি এই জগতে।
আশ্রমে দুটি ঈষৎ ট্যারা ছেলেকে দেখবেন। হ্যাঁ, তাদের চোখ দিয়েই পীতাম্বর বাবু সবকিছু দেখেন। মধ্যমগ্রামের এক যুবকের দেহে রয়েছে তাঁর কিডনি।

এবার চল, অনেক রাত হল।
হ্যাঁ তাই তো। ঘোর কাটছিল না ঈশানের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত্রি ৯ টা বেজে দশ। আশ্রমে ৯.৩০ এ খাবার ঘন্টা বাজে। তাই সে মহারাজকে বলল, আপনি গিয়ে ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বালুতট ধরে এগিয়ে যায় ঈশান। ভাদ্রের ছেঁড়া মেঘের ভেতর থেকে হাল্কা চাঁদের আলো আসে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে ঈশানের পায়ে। বাতাসের আর সমুদ্রের আওয়াজ মিলে মিশে অদ্ভুত এক আবহ সৃষ্টি করে।
ঈশান যেন শুনতে পায় পীতাম্বরবাবু শঙ্কর বাবুকে বলছেন, শঙ্করদা, সেবার গোমুখ যেতে গিয়ে সে কি কাণ্ড.‌.‌.‌।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.