Categories ভ্রমণ

দক্ষিণবঙ্গেও আছে একটুকরো ডুয়ার্স

অন্তরা চৌধুরি

জঙ্গলে যাব মনে করলেই মনটা কেমন ডুয়ার্স ডুয়ার্স করে ওঠে। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, ঠান্ডা আবহাওয়া সবই তো উত্তরবঙ্গে। তাই বলে দক্ষিণবঙ্গের কপালে শুধুই গরম আর রুক্ষ প্রকৃতি? না। আমাদেরও আছে। দক্ষিণবঙ্গের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো ডুয়ার্স।

জায়গার নাম সুতান। জঙ্গল মহলের এক প্রান্তিক ঠিকানা। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। বাঁকুড়া শহর থেকে খাতড়া মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েকের পথ। সেখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে মুকুট মণিপুরের দিকে। আরেকটা রাস্তা রাণীবাঁধ–‌ঝিলিমিলির দিকে। খাতড়া পেরোনোর পর থেকেই প্রকৃতির দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। গরমকালে এলে রাস্তার দু’‌পাশে ছড়িয়ে থাকবে পলাশ ফুল। আবার কোথাও ঝকঝকে রাস্তার দু পাশে সোনাঝুরি আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। রানীবাঁধ পেরোতেই জঙ্গল যেন ঘন হতে থাকে। বেশ একটা গা ছমছম করা অনুভূতি। বারোমাইল জঙ্গল পেরিয়ে বাঁদিকে ছোট্ট একটা পাহাড়ি রাস্তা চলে যাচ্ছে সুতানের দিকে। পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে গাড়ি তখন একটু একটু করে পাহাড়ে উঠছে। দু’‌পাশে শাল, পিয়াল, সেগুনের ঘন জঙ্গল। অরণ্যের বুক চিরে কিছুদূর যাওয়ার পরই এসে গেল সুতান।

সুতানে ঢোকার আগে এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক, আমরা মাঝপথে নেমেছিলাম সুপুর বলে একটা জায়গায়। খাতড়ার আগেই। অনেকেই সেখানে নাকি ছোট্ট একটা ব্রেক নেন। চা, আলুর চপ খাওয়ার পাশাপাশি সুতানে রান্না করার ইচ্ছে থাকলে এখান থেকে টুকটাক জিনিস কিনে নেওয়াই ভাল। নানারকমের টাটকা সবজি তো আছেই, দেশি মুরগি, মাছ বা খাসি মাংসও পেয়ে যাবেন। সুতানে রান্নার পরিকল্পনা থাকলে নিয়েও নিতে পারেন। আমাদের অবশ্য রান্না করার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল না।

আবার অরণ্য ঘেরা সুতানে ফেরা যাক। পৌঁছেই চোখে পড়বে এক বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে উঠে মাইলের পর মাইল এই আদিম অরণ্যের বিস্তৃতি দেখা যায়। যতদূর চোখ যাবে, শুধুই জঙ্গল। সেই ওয়াচ টাওয়ারের পাশেই রয়েছে এক সুবিশাল জলাশয়। একটা সরকারি কটেজও রয়েছে। তৈরি হয়ে গেছে। লকডাউনের কারণে কিছু কাজ থমকে গিয়েছিল। তখনও উদ্বোধন হয়নি। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা মূলত মুকুট মণিপুর বা ঝিলিমিলিতে ঠাঁই নেওয়া পর্যটক। সেখান থেকে আশপাশ ঘুরতে গিয়ে সুতানে ঢুঁ মেরে যান। কিন্তু একটু পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে সুতান নিজেই একটা দুরন্ত পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

সুতানে আর কী আছে, এই প্রশ্নে একটু হোঁচট খেতে হয়। কারণ এমন আদি অকৃত্রিম প্রকৃতির মাঝে শুধু প্রকৃতিই আছে। জঙ্গলকে যদি ভালবাসেন তাহলে এমন নিবিড় অরণ্যের মাঝে একটা দিন কাটানোর সুযোগ মিস না করাই ভাল। আমরা ওয়াচ টাওয়ারের ওপর মুড়ির সরঞ্জাম সাজিয়ে খেতে বসে গেলাম। বলে রাখা ভাল, গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটিতে কোনওরকম দোকানপাট নেই। তাহলে, দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা কী হবে? ইচ্ছে থাকলে সে উপায়ও হয়ে যাবে। আমরা চলে গেলাম সামনের এক সাঁওতাল গ্রামে। সেখানে গিয়ে রান্নার কথা বলতেই বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। হাসিমুখে রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে এসে উনুন তৈরির কাজে লেগে পড়লেন। রান্নার যাবতীয় দায়িত্ব পরম নিশ্চিন্তে তাকে দিয়ে আমরা আশপাশটা ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। যদি মাংস বা সবজি আনেন, তাহলে তো সমস্যাই নেই। যদি নাও আনেন, তাহলেও চিন্তা নেই। ওঁদের হাতে ছেড়ে দিন। ওঁরা ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন।

ঘন শাল জঙ্গলের মাঝে পাথুরে লালমাটির পথ। সেই পথ ধরে প্রিয়জনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে গহীন অরণ্যে। এত কাছ থেকে, এত নিজের করে প্রকৃতিকে বোধহয় ডুয়ার্সেও পাওয়া যায় না। কয়েক বছর আগেও এই জায়গাটি মাওবাদীদের ডেরা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। একটা চাপা আতঙ্কের চোরাস্রোত ছিল। সেই কারণেই মাঝে দীর্ঘিদিন পর্যটকদের আনাগোনাও প্রায় বন্ধই ছিল। কিন্তু এখন আর সেই আতঙ্ক নেই। এখন পরম নিশ্চিন্তে প্রকৃতির এই সাহচর্য উপভোগ করতে পারেন। যদিও দলমা রেঞ্জ, কিন্তু জন্তু জানোয়ারের তেমন ভয় নেই। হাতি আসে, তবে কদাচিত। হাতির আগমনবার্তা পেলে স্থানীয়রা আগাম সতর্ক করে দেবেন। তাই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ান। হারিয়ে গেলে ওয়াচ টাওয়ার দেখে অনায়াসেই ফিরে আসতে পারবেন।

পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে আমরা তখন সেই জলাশয়ে নেমে স্নানপর্ব চুকিয়ে ফেলেছি। চারিদিকে বড় বড় গাছপালা দিয়ে ঘেরা সেই সুবিশাল জলাশয় সুতানের অন্যতম আকর্ষণ। চাইলে, এক রাউন্ড সাঁতার ঝালিয়ে নিতেও পারেন। ওদিকে রান্নাও ততক্ষণে রেডি। সাঁওতালদের হাতের মুরগি রান্নার এমনিতেই একটা সুখ্যাতি আছে। পিকনিকের জন্য ওখানে ছোট ছোট সিমেন্টের বেদি করাই আছে। আমরা সেখানে বসে পড়তেই আমাদের রান্নাকাকু পরম যত্নে পরিবেশন শুরু করে দিলেন। তিনি গাছ থেকে টাটকা শালপাতা পেড়ে থালা তৈরি করে ফেলেছেন। আমাদের পাতে পড়ল গরম গরম মোটা চালের ভাত, পেঁয়াজ দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ, মাছের মাথা দিয়ে একটা তরকারি, মাছের ঝাল আর গরমাগরম মুরগির ঝোল। ওইরকম গভীর জঙ্গলের মাঝখানে এইরকম খাবার! আহা! মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে। সকলে ডায়েটিং ভুলে গেল। বাড়িতে যা খায় তার চেয়ে কিছুটা বেশি পরিমানেই খেয়ে ফেলল। শীতের বেলা। খাওয়া শেষ হল, যখন তখন সূর্য পাটে বসেছে।

আমরা নিজেদের আবার অরণ্যে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.