‌ম্যাকলাস্কিগঞ্জে, বুদ্ধদেব গুহর সেই বাড়িতে.‌.‌.‌

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

‘ওহি যে বড়া ঘর দেখছেন, টিলা কা উপর, ও কলকাত্তাকা এক বহুত বড়িয়া বাবুকা মোকান থা। লিখতা থা…বহুত লিখা, ইস জায়গা নিয়ে…….’
ভাঙা-ভাঙা বাংলা আর দেহাতি হিন্দি মিশিয়ে যে দেহাতি মানুষটি আমাদের বাড়িটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, টিলার উপর, জঙ্গল ভেদ করে, তাঁকে বললাম, ‘তুমি কি বুদ্ধদেব গুহর কথা বলছ? লেখক?’
শুনেই ‘হাঁ–হাঁ’ করে উঠলেন মানুষটি। ‘ওহি–ওহি!’ মেরা পিতাজি ইস কোঠিকে কাম করতে থে। ম্যায় ভি ছোটবেলায় এসেছি। দেখেছি বাবুকে। একদম সাহেব ছিলেন! বন্দুক ভি ছিল!’
অনেক বছর আগের কথা। বছর ১৮–২০ তো হবেই। তখন আমরাও তরুণ। সবে পেশায় এসেছি। হঠাৎ ঠিক করলাম, নেতারহাট যাব। আমি, আমার সব ‘অপরাধ’–এর সঙ্গী কুণালদা আর পাড়ার বন্ধু চিরঞ্জিত।
মাঝরাতে ট্রেন ধরে বেরিয়ে পড়া। প্রথমে লক্ষ্য ছিল রাঁচি পৌঁছে সেখান থেকে নেতারহাট যাব। কিন্তু সেদিন ছিল মাওবাদীদের ডাকা বনধ। কেউ আর ওই পথে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে না। কী করা যায়, এক অটো ধরে ঠিক করলাম, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ চলে যাব। কী ভাবে গিয়েছিলাম, কী ঘটেছিল, সেই রোমহর্ষক গল্প পরের ধাপে বলছি। প্রথমে শুধু বুদ্ধদেব গুহর বাড়ি।
জঙ্গলে ঢাকা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, দেড়শো বছর আগের চার্চ, স্কুল, সাদা পোশাকের পাদ্রী, দূরে পাহাড়ের হাতছানি, সব সে দিন ছাপিয়ে গিয়েছিল ওই বাড়িটার সামনে এসে।

টিলার উপর বেশ অনেকটা উঠতে হয়েছিল। সামনে বিশাল বারান্দা। খোলা ছাদের মতো। মাথায় বিবর্ণ লাল টালি। গ্রিল ভেঙে পড়েছিল। পিছন দিকে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া কালো ইঁটের চিমনি। এক্কেবারে সাহেব বাংলো।
সেই দেহাতি মানুষটি বলে চলছিলেন, ‘ওই বাবুর পর আপনাদেরই কলকাতার একজন হিরোইন এহি মোকান খরিদ করেছিল। এসেওছিল। কিন্তু একবার এই মোকানে ডাকু পড়ল। তারপর থেকে আর কেউ আসে না। মোকানভি ভেঙে গেল! আভি পুরা জঙ্গল হো গ্যায়া!’ বুদ্ধদেব গুহর বিভিন্ন লেখাতেই পড়েছি, আগে ওই বাড়ি ছিল মহাশ্বেতা দেবীর। তাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। সেখান থেকে হাতবদল হয়ে যায় অপর্ণা সেনের কাছে।
অদ্ভুত বিশেষত্ব ছিল বাড়িটার। সামনে ছাদের মতো ছড়িয়ে টিলার উপরের অংশ। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে, পুরো নীচেটা দেখা যেত। সবুজ জঙ্গলে ভরা। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরে পাহাড়ের হাতছানি। দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে মনে হবে সবুজ সমুদ্রের সামনে যেন শূন্যে ভাসছেন! আজও ছবির মতো মনে আছে সব কিছু।
বুদ্ধদেব গুহ জীবনটাকে দেখতে চাইতেন বড় করে। বিভিন্ন লেখায় তাঁর চরিত্রদের তিনি বলিয়েছেন, ‘জীবন হবে বড় বাঘের মতো!’ আসলে, নিজেই তো বাঁচতেন সে ভাবে।
সেই রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। মহুয়ার নেশায় আমরাও তখন ভাসছি। হঠাৎ মনে হল, চল এই রাতে দেখে আসি বাড়িটাকে। কী ভাবে পৌঁছে গিয়েছিলাম ওই জঙ্গল পাহাড় ভেঙে আজও জানি না! পরের দিন স্থানীয় মানুষরা বকাঝকা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জানো ভাই, এখানেও এখনও বাঘ বের হয়।’
তাঁদের বলা হয়নি। আজ বলছি, সেই রাতে ‘বাঘ’ দেখতেই তো ওই বাংলোয় গিয়েছিলাম আমি। দেখতে গিয়েছিলাম তাঁকে, যিনি বাঘের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন! চাঁদের আলোয় হয়তো দেখেছিলাম তাঁকেই। বাংলোর খোলা ছাদে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো এক বিশাল চেহারার মানুষ!
বুদ্ধদেব গুহ! বাংলা সাহিত্যের ‘দ্য রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’!
মাঝরাতে, জঙ্গলে যাওয়ার সাহস, নদীর শব্দ শোনার ইচ্ছে, সে তো আপনার জন্যই!
এ বার এই সফরেরই একটু আগের ঘটনা শোনাই।
সে বার আমাদের ম্যাকলাস্কিগঞ্জে যাওয়ারই কথা ছিল না। ঠিক ছিল রাঁচিতে নেমেই নেতারহাটের বাস ধরব। তখনও জানি না, কী ঘটতে চলেছে!
বেশ সকালের দিকে রাঁচি–হাতিয়া এক্সপ্রেস নামিয়ে দিল রাঁচিতে। স্টেশনেই মুখ, হাত–পা ধুয়ে চা খেয়ে রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে।
সেখানে গিয়ে মাথায় হাত! শুনলাম, মাওবাদীরা বন্‌ধ ডাকায় সে দিন আর নেতারহাটের কোনও বাস ছাড়বে না! যা ছাড়বে, সব পরের দিন।
এ দিকে, হাতে মাত্র দু’দিন সময়। ফেরার টিকিট কাটা। তা হলে, এতটা এসে ফিরে যাব না কি!
হঠাৎ কী মনে হল, দুম করে মাথায় এল ম্যাকলাস্কিগঞ্জের নাম। এটাও বুদ্ধদেব গুহরই অবদান। তাঁর লেখা কখন যে মগজে নামটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, জানতেই পারিনি।
ভাগ্যও সুপ্রসন্ন ছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নেতারহাটের দিকে বনধ হলেও ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দিকে সব ঠিক আছে।
এ বার, খোঁজ নেওয়ার পালা, কী ভাবে যাব। বাসস্ট্যান্ড থেকে বলা হল, ম্যাক্সলাস্কিগঞ্জের একটাই বাস ছাড়ে। সেটা আমরা আসার আগেই চলে গেছে। আর কিছু নেই।
তা হলে উপায়!
হোটেলে খেতে গিয়ে হঠাৎ পরিচয় হল এক অটো চালকের সঙ্গে। আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে আলোচনা করছি শুনে তিনি উঠে এসে হিন্দিতে বললেন, ‘আপনারা কি যাবেন ওখানে? চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
ভাড়া?


হাজার রুপিয়া! দরাদরি করে সেটা নামল আটশোতে।
মন তখন দারুণ খুশ। যাই হোক, একটা হিল্লে হল। কিন্তু ঘণ্টা খানেক অটো ভ্রমণের পর বুঝতে পারলাম, ওই অটোচালক ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নামটা শুনেছেন, কিন্তু জায়গাটা কোথায়, কী ভাবে যেতে হয়, কতক্ষণ লাগে, এ সব কিছুই জানেন না! ভালো ভাড়া হবে ভেবে দুম করে চলে এসেছেন!
তারপরেও জিজ্ঞাসা করতে–করতে আরও কিছুটা এগোনো গেল। বিপত্তি তারপরেই!
সামনের রাস্তা উঁচু হয়ে উঠে গিয়েছে সোজা। পাহাড়ি রাস্তা যেমন হয় আর কী! ব্যাস, অটো আর ওঠে না। ঘড়ঘড় করে আওয়াজ করে একটু এগিয়েই পিছনে গড়িয়ে আসছে। অটোচালকের তখন কান্না পাওয়ার অবস্থা!
শেষে সবাই নেমে দাঁড়ালাম। অটো উঠছে। আমরা পিছনে হাঁটছি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে! একটু এগিয়ে যেখানে রাস্তাটা কিছুটা সমতল, সেখানে দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ছি অটোতে। আবার খাড়াই রাস্তা হলে নেমে হাঁটা। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
এ ভাবে চলতে–চলতে কী ভাবে যে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে পৌঁছেছিলাম, তা–ও আজও ভাবলে অবাক লাগে!
অটো চালক তখন মাথা চাপড়াচ্ছেন। শেষে বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে শান্ত করা গেল। বললাম, নামার সময় তো গড়গড় করে গড়িয়ে যাবে। চিন্তা কী!
আর চিন্তা! বুদ্ধদেববাবু জানলে, এটা নিয়েই আস্ত একটা গল্প লিখে বসতেন। নিশ্চিত!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.