জনপ্রিয় সংস্কৃতির নামে চলছে মধ্যমেধার দাপট। পাবলিক কী ‘খাবে’, সেটা নির্ধারণ করে দিচ্ছে কর্রোপেট সংস্কৃতি। তাদের ইশারাতেই চলছে মূলস্রোত মিডিয়া। ভিন্ন স্বাদের একটি লেখা। লিখেছেন অম্লান রায়চৌধুরী।।
মিডিয়া– সংস্কৃতি এবং মিডিওক্রেসি–এরকম কথাবার্তা গণমাধ্যমে অনেকে শুনে থাকবেন বা পড়ে থাকবেন। কয়েকদিনের পত্রিকা খুললে বা টিভি– রেডিও খুললেও এগুলো দেখে আপনারও মনে হবে আপনিও হয়ে যেতে পারেন এগুলোর রচয়িতা– কিংবা পরিবেশক। কারন আপনার তেমন কোনও ইমপ্যাক্ট আসছে না মনের উপরে ।
‘জনপ্রিয়’, ‘সেলিব্রেটি’ ‘মিডিয়ার লোক’ বা ‘তারকা’ লোকজনের ইন্টারভিউ, মন্তব্য, কথাবার্তা, – মনে হবে সবই যেন নিজেই তৈরি করা যায় – মনে হবে যা বলছে বা বলানো হচ্ছে- নতুন কিছু নয়, তবুও সময়টা কাটছে, বাক্সে চলা ফেরা দেখা যাচ্ছে – মোহর মতন – মনে হয়।
এটা একটা গৎ– ‘বিনোদনের ফরম্যাট’– ভালো লাগে, ‘মজা’ আছে ‘আনন্দ’ ও আছে। এতে বা এগুলোকে পরিবেশনে গণমাধ্যমের ভূমিকাটা বেশ নগন্য- খানিকটা আজ্ঞাবহ–র মতন।
দেখা যাক এই ‘আনন্দ’, ‘ বিনোদন’ ও তাদের আয়োজনে– তাদের খবর– ফিচার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মূল ধারার ‘গণমাধ্যম’– সমাজ– সংস্কৃতিতে যে রাজনীতিটা করছে– কেমনভাবে করছে– কতটা করতে পেরেছে– কিংবা কতটা সমাজের ক্ষতি করেছে ।
আনন্দ- বিনোদন বলতে গান- নাটক- সিনেমা- নাচ- ছবি আঁকা, মেলা ইত্যাদিকেই বোঝানো হয়। সেই ভাবে দেখতে গেলে– কোনও পত্রিকার ‘আনন্দ-বিনোদন’ পাতায় বেশিরভাগ অংশজুড়ে থাকে দেশীয়, ভারতীয় এবং হলিউড ‘সেলিব্রেটি’ এবং সংস্কৃতি-পণ্য নিয়ে ফিচার। বলিউড সংস্কৃতির বার্তা ছাড়া পত্রিকার বিনোদন পাতা পবিত্র হয় না। হলিউড তো স্বর্গের দেব-দেবীদের পদস্পর্শে ধন্য। তার কোনও কিছু ছাড়া হয় না– এদের গুণকীর্তন ছাড়া কী করে ‘সংস্কৃত’ বান হওয়া যায়!
অল্প স্থান পায় মঞ্চনাটক– গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড– কত নতুন সৃষ্টি– কত কম পরিসরে– কত কম অর্থের যোগানে– কত বাধার মাঝে উপস্থাপনা হয়– জানা হয় না এদের কথা– এদের সংগ্রামের কথা– এদের ‘সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার আমরণ চেষ্টার কথা ।
মাঝে মধ্যে ‘বিখ্যাত’ কোনও ‘উচ্চাঙ্গ’ সঙ্গীতশিল্পীরা আক্ষেপ করেন– যে ‘উচ্চাঙ্গ’ সঙ্গীতকে ‘মিডিয়া’ জায়গা এবং গুরুত্ব কম দিচ্ছে। যদিও ‘উচ্চাঙ্গ’ প্রতিথযশা শিল্পীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খাটে না– কারণ ওটাও পাবলিক খাবে- এই সমস্ত পাবলিকদের অধিকাংশই আবার এমন একটা ভাবে চলে যেখানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতটা নিজের অবস্থানের মাপকাঠি। ওটাকে রাখতেই হবে, বোঝাতে হবে যে আমিও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বুঝি, উপস্থিত থাকি, না হলে তো সেই সমাজচ্যুত। অবশ্যই সেই সমাজেই, যেখানে সবাই প্রায় এই ভাবনায় পারদর্শী ।
মূলধারায় জায়গা পাওয়াটা পুরোপুরি নির্ভর করে ‘জনপ্রিয়তা’ র অথবা কতটা লোকে ‘খাবে’ বা ‘খাওয়ানো’ যাবে তার উপর । ‘জনপ্রিয়তার’ সাথে মাপকাঠি জুড়লে কেমন যেন ছোটো পায়ে বড় মাপের চটি গলালে যেমন অবস্থা হয় তেমন মনে হয়। কিছুতেই বাগে আনা যাবে না ধরে নিয়েই –‘জনপ্রিয়তা’ র পরীক্ষায় পাস করানো হয় । এগুলো সবই ভিতরের ব্যাপার ।
কাজেই এর মাপকাঠি– ভীষন গোলমেলে ও তর্ক সাপেক্ষ । যেমন ‘সংস্কৃতি’ নিজেই এক বিতন্ডিত বিষয়। আমরা খুবই শুনি, তর্কও শুনি– ‘উচ্চাঙ্গ (high)’, ‘মাঝারি’, ‘পপুলার (popular)’ বা ‘লো ( low)’ বা ছোটলোক শিল্প এবং সংস্কৃতি নিয়ে। এগুলো নিয়ে একটু ভাবা যেতেই পারে ।
‘গণ’-কথাটার মানে হল মোটামুটি ভাবে-‘গণসমাজ’। এর বর্তমান অবস্থানটার উৎস পশ্চিমের শিল্প বিপ্লবের পর। বিশাল শ্রমিক শ্রেণী- পাশাপাশি ব্যবস্থাপক- নির্বাহীদের উপস্থিতি। পরিবারের মতো সনাতন প্রতিষ্ঠানের সমাজে সাংস্কৃতিক প্রভাব কমে যাওয়া এবং ক্ষমতার কেন্দ্রটা সরে গেল। মালিক-ব্যবস্থাপকদের একটা নতুন– শ্রমিক- দ্বন্দ্ব ও সমঝোতায় এল এক নতুন সমীকরণ । এটাই পাল্টে দিল সমাজের সাবেকি চেহারাটা। তৈরি করল এক নতুন সাংস্কৃতিক উৎপাদন ও তার চাহিদা। সম্পূর্ণ হল চাওয়া ও পাওয়ার বৃত্ত।
এর ফলে প্রাচীন ‘লোক’ এবং ‘এলিট’ সংস্কৃতি– যেগুলো টিকে ছিল শুধু শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় ও বেশ কিছুটা আত্মত্যাগে– আঘাত এল বেশ বড় মাপের ‘অর্থনৈতিক’ বেসাতি নিয়ে আসা ‘গণ’ বা ‘পপুলার’ বা ‘জনপ্রিয়’ সংস্কৃতির কাছ থেকে। এটাই হল গিয়ে নতুন সংস্কৃতি ।
স্বাভাবিক ভাবেই নতুন এই বিশাল সাংস্কৃতিক পণ্য বাজার পুঁজির নজর এড়াবে কি করে । ঝাঁপিয়ে পড়ল এই সংস্কৃতির আনাচে কানাচে– নানান স্ট্র্যাটেজি নিয়ে । গড়ে উঠল ‘আধুনিক’ সংস্কৃতি বাণিজ্য বা কালচার ইন্ডাস্ট্রি (culture industry )। এরা প্রায় রাতারাতি ‘গণ’র চাহিদা মেটানোর চেষ্টা শুরু করল– পাশাপাশি ‘গণচাহিদা’কেও নিজের ছাঁচে ফেলার একটা সুপরিকল্পিত ধাঁচা তৈরি করল– যাতে বাস্তব ক্ষমতা থেকে পুঁজি তৈরি হওয়াটা নিশ্চিত হয় ।
এর ফলে মানব সভ্যতা নতুন এক সাংস্কৃতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। বেশ কিছু জটিল সমস্যাও হাজির হল এই সংস্কৃতির হাত ধরে। যেমন- ‘উচ্চাঙ্গ’- নিম্নাঙ্গ’ শিল্প ও সংস্কৃতির আপাতদৃষ্টিতে গরহাজির দ্বন্দ্ব, ‘পপুলার’ বা ‘জনপ্রিয়’ বনাম ‘সিরিয়াস ( serious)’ শিল্প- সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব। আর্ট এবং ‘পুঁজি’র দ্বন্দ্ব। এখানে জানা উচিত, দ্বন্দ্ব বলতে শুধু দ্বৈরথ দ্বন্ধ যেন না বুঝি। দ্বন্দ্বের যে বহুমাত্রিকতা আছে সেটাই যে দ্বন্ধকে দেয় পরিপূর্ণতা সেটাকেও মাথায় রাখার দরকার।
পুঁজিতন্ত্রে পণ্যর কেনা বেচা স্বভাবতই নির্ভর করে বেশ কিছু আবশ্যিক শর্তের উপর, যেটা আজ প্রায় সকলেরই জানা। এই শর্ত পালন করতেই হবে এবং এগুলো করতে গিয়ে পুঁজি এবং ‘আর্ট’ এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে যেখানে ‘আর্ট’ হারায় তার স্বতস্ফূর্ততা, স্বাভাবিকতা বা সবশেষে নিজস্ব সৃজনশীলতা। অন্যদিকে ‘আর্ট’-এর বাইরের বেশ কিছু সাংস্কৃতিক আবহ এই বাজার সম্পর্কের মধ্যে পড়ে যায়– এর উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে আমাদের চারপাশে।
কাজেই গোটা ‘গণমাধ্যম’কে বাজারি বলতে আর কোনও দ্বিধা নেই। সে নিজেই যখন বাজারি তখন তার প্রধান ভূমিকা কী হবে সেটাও ঠিক করে দেয় এই কালচার ইন্ডাস্ট্রির তথা পুঁজির নিজস্ব যুক্তি। নিজস্ব নিয়ম। নিজের বৈশিষ্ট্য। যা কিছু লোকে ‘খায়’ এবং যা কিছু লোককে ‘খাওয়ানো’ যায়, যা কিছু পুঁজির নিজের স্বার্থে ‘খাওয়ানো’ দরকার, তার সব পসরা নিয়ে সে হাজির হতে থাকে।
এই ‘খাওয়া’র একটা বিনোদন মাত্রা আছে। এই ‘খাওয়া- খাওয়ি’র জন্যই বাজারি গণমাধ্যম একটা জনসংস্কৃতিকে তার নাড়ির যোগ থেকে ‘সাংস্কৃতিকভাবে’ই সরিয়ে নিয়ে, জনগণের যাপিত- জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে কালচারাল প্রোডাক্ট বা সাংস্কৃতিক পণ্যে পরিণত করে। এর জন্য অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টি করতে এ পণ্যের বণিক-সওদাগর- হবু- গবুদের সমাজে আদর্শায়িত করে তাদের মধ্যস্থতায় ‘বিনোদন’ শিল্প থেকে সমাজে নানারকম ধারণা ও মূল্যবোধ আনা- নেওয়া করে।
এই খাওয়া-খাওয়ি শিল্পসংস্কৃতি এবং এর থেকে মুনাফার ইচ্ছার রাস্তাটাকে নিশ্চিত করতে শ্রমিক-উৎপাদক- মালিক- ব্যবসায়ী- ব্যবস্থাপক- নির্বাহী- সবার জন্য ‘সহজ রাস্তা’ হল ‘মিডিওক্রেসি’ (mediocracy)-যাকে পরিচিত নামে বলা হয়-মাঝারিমান । তাই এই মাঝারিমান জিন্দাবাদ নীতিই এখন বলবৎ।
এটাও বোধ হয় ভুললে চলবে না যে আর্ট– পুঁজির এই যে সম্পর্কের মধ্যে নানা মাত্রিক যে জটিলতা আছে তাতে সব পক্ষের কাছে যা সবচেয়ে আরামদায়ক, সেটার সমাধানও কিন্তু সেই ‘মিডিওক্রেসি’– আমরা যে নামেই ডাকি না কেন ।
এই ‘মিডিওক্রেসির’ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে– যেখানে ওরা ধরে নেয় যে সাধারণ লোকেরা কম বুঝবে আর এই কম বোঝাবার দায়িত্ত্বটা মোটামুটি ভাবে দেখভাল করবে বাজারি মিডিয়া ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা। মুখে তারা ‘উচ্চমান’ বলবে। কাজে করবে মাঝারিমানের সেবা। গালাগালি করবে ‘নিম্ন’-মানের সংস্কৃতির। মাঝেমধ্যে ‘উচ্চ’ সংস্কৃতির বা ‘ক্রিটিক্যাল’ বা র্যাডিক্যাল সংস্কৃতির ছিঁটে-ফোঁটা-ফিলার দেবে। তা না হলে বৈধতার সংকট সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কিন্তু শিল্প- সংস্কৃতি–উচ্চ- মাঝারি বা নিম্নমানের- সেই সমাধানটা আর হল না। নতুন একটা মাত্রায় পৌঁছালো মাত্র। জানিনা এটাকে কি বলা উচিত ।
মিডিওক্রেসি তাই ‘আমজনতা’র জন্য সাংস্কৃতিক মাল বা পণ্য ব্যবসা শুধু নয়। ‘মিডিওক্রেসি’ হল সংস্কৃতি ব্যবসার (culture industry) ফন্দি- ফিকির- তরিকা- পদ্ধতি- কৌশল । এর মূখ্য উদ্দেশ্যই হল টিকিয়ে রাখা, বুঝতে না দেওয়া, পরিবর্ত কিছু না ভাবার পথটাকে বেষ্টন করা নিবিড় ভাবে– এক সমস্যাহীন উদাসীন ভাবনার জন্ম দেওয়া বিনোদনের আঙ্গিকে। তাই ‘মিডিওক্রেসির’ প্রাণ ভোমরা হলো ‘পপুলিজম’। জনপ্রিয়তাবাদ। জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে নগদে ক্ষমতা ও অন্যান্য ধান্ধা করাকেই পপুলিজম বলা যায়। জনপ্রিয়তা সবসময় খারাপ জিনিস না। কিন্তু জনপ্রিয়তা সবসময় ভালো জিনিসও না। পুরুষতান্ত্রিক অনেক সংস্কৃতি এখনও দুনিয়ায় জনপ্রিয়। জনপ্রিয় কালোকে ঘৃণা করা। ইত্যাদি। এর কোনওটাই ভালো না। আবার, পুঁজিতন্ত্র ও বাজারি মিডিয়া নিজের প্রয়োজন মতো মাপঝোক দিয়ে ‘জনপ্রিয়’, ‘তারকা’, ‘সেলিব্রেটি’ বানিয়ে নেয়। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়। ফলে, জনপ্রিয়তা, ভালো-মন্দ- সবই চূড়ান্ত অর্থে রাজনৈতিক।
মিডিওক্রেসির রাজনীতি হল জনপ্রিয়তার নামে সব পর্যালোচনাহীন, খেলো, পলকা, নিষ্প্রাণ, নির্বিচার ভোগবাদি, প্রতিক্রিয়াশীল সব শিল্প- সংস্কৃতি ও তার ‘জনপ্রিয়’, ‘তারকা’, ‘সেলিব্রেটি’দের আদর্শায়িত করা এবং এই ধারাকে টিকিয়ে রাখা।
‘পাবলিক’ চায়, ‘পাবলিক’ খায়- বলে ‘পপুলার মিডিয়া’ বা ‘জনপ্রিয় মিডিয়া’ যেভাবে ‘মিডিওক্রেসি’ র দাপট ‘পাবলিক ’কে আফিং খাওয়ার মতন বুঁদ করে রাখছে–সেখানে প্রশ্ন জাগে সত্যি সত্যিই ‘পাবলিকে’ র ভূমিকা ঠিক কী? এই অবস্থায় বা কী হওয়া উচিত? জনগন কি কেবলই এই ‘মাঝারিমানের’ লম্ফ ঝম্ফের নিষ্ক্রিয় ভোক্তা?
বলা খুব মুশকিল– কারন ‘পাবলিকে’ র হাতে খুব একটা অপসন নেই যে পছন্দের তালিকা থেকে কিছু একটা বেছে নেবে।
আর্ট-কালচার- এবং এর অ্যাপ্রিসিয়েশন বা সমঝদারি বা প্রশংসা– নিজেই একটা সামাজিক- সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়াসহ নানারকম প্রতিষ্ঠান এবং জীবনের নানান পরিক্রমা থেকে উৎপাদিত ‘জ্ঞান’, ‘সচেতনতা’ ও সম্মতি আর্ট-কালচারের গড্ডালিকাকে টিকিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। এটা স্বতসিদ্ধ যে সমাজে পর্যালোচনার সংস্কৃতি যদি প্রভাবশালী হয় পজিটিভ হয় সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশ হতে বাধ্য। যে বিকাশ আনুষঙ্গিক অনেক ধারাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ে ওঠে, ফলে গতিশীল হয়। এটা দেখা গেছে নানান দেশে নানান সময়ে। আমাদের দেশ তো আছেই। কিন্তু ‘পাবলিক’ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এক নতুন অবস্থায় যেখানে দরকার হয় পর্যালোচনাহীন, খেলো, পলকা, নিষ্প্রাণ, নির্বিচার ভোগবাদি, প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ ও সংস্কৃতির আধিপত্য থেকে সমাজ-জনগণের মুক্তির প্রক্রিয়ার স্বাদ । যেটা চটুল । মনোহারি ও ভীষণভাবে ভাববাদী– যেমন একান্নবর্তী পরিবারের বাঁধনকে শক্ত করতে দেখান হয়, জানান দেওয়া হয় বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে, চাক্ষুস করানো হয়– অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মানুষের বা ব্যক্তির মোহকে অস্বীকার করে। যেটার কোনও ভিত্তি নেই আজকের সমাজে। লোকে ভাবতে থাকে। স্মৃতিকে টান দেয়। আরাম বোধ হয়। ভাবে হয়ত মুক্তির পথ ওটাই ।
অনেক মানুষ এখনও কিন্তু এই আধিপত্য থেকে মুক্ত। তাই সেই ধরনের আর্ট-কালচার সমাজে প্রান্তিক হলেও হাজির আছে এবং জনগণের একটা অংশ তার সমঝদারিও করে। বাকিরা করে পণ্যসংস্কৃতির দাস্যবৃত্তি।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বোধ হয় মনে রাখার প্রয়োজন আছে যে শ্রেনীবিভক্ত সমাজে আর্ট – কালচার মানুষের জীবনের অন্তরঙ্গ ব্যাপার। কাজেই প্রত্যেকটাতেই পাওয়া যায় ভিন্ন স্বাদ। অজানা মোড়কে, শ্রেনীর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যর নানান ছটা। তাই দরকার আলাদা করে খেয়াল রাখার। সমঝদারিদের কাজও হয় কঠিন। কিন্তু প্রয়োজন যে আছে সেটা মানতেই হবে । সমঝদারিদের প্রসঙ্গ আসবেই।
এতক্ষণ বাজারি গণমাধ্যমের সংস্কৃতি নিয়ে রাজনীতির যা যা লক্ষণ- আলোচনা হল, তার প্রায় সবই ভারতের গণমাধ্যমে উপস্থিত। মূলধারার ‘গণমাধ্যম’কে আজকের দিনে আর ‘গণমাধ্যম’ বলা যায় কিনা সেই প্রশ্ন এখানে রাখা যায়। ভারতের উদাহরণই যদি ধরি, সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল জনসমাজের নানান সংগ্রামের হাতিয়ার ও সহযোগী হিসেবে। উপনিবেশসহ সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। আজকের ভারতে বেশিরভাগ সংবাদপত্র এবং অন্যসব গণমাধ্যম কর্পোরেট পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ- লুটপাটের হাতিয়ার ও সহযোগী।
এর কারণ উদ্যোক্তা– অর্থাৎ যারা বিনিয়োগ করবে, তাদের চারিত্রিক গঠন, মানসিকতা ও সর্বোপরি তাদের নিজেদের জীবনে বেড়ে ওঠার রাস্তাটা। যেটার প্রত্যেকটা বাঁক মসৃন হয়ে ওঠেনি, ফলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পয়সাওয়ালা, হয় প্রোমোটারি কিংবা ক্ষমতা বেচার দালালি, তারাও ঢুকে পড়বে এই খেলায় – মুনাফাও করবে। পাবলিক বোকাও বনবে। এগুলোকে মানতে হচ্ছে আজকের এই শতাব্দীতে বসে। আমি আকবর – তানসেন বা বীরবলের অনুসঙ্গ চাইনি– অন্তত রসবোধ সম্পন্ন উদ্যোক্তা তো কমপক্ষে থাকবে যে অনেকটা আমাদেরই অনেক জমিদারের মতন–পুরো দায়িত্ব নিয়ে এক কীর্তনীয়াকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে– হ্যাঁ জমিদারের নাম ফেটেছে। হোক না এই নামের বেসাতি আজকেও, তবুও তো এক সৃজনশীলতার জন্ম হবে। যেটা ওর প্রাপ্য। মুনাফা আর ফাঁকা জনপ্রিয়তা না হয় বাদই দিলাম। এটা আশা করা কি খুবই অস্বাভাবিক।
সাম্র্রাজ্যবাদের যুগে সংস্কৃতির গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য দরকার হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ, জনগণের স্বার্থের অর্থনীতির বিকাশ, যাতে করে বহুজাতিক কর্পোরেটের সেবায়েত কালচার ইন্ডাস্ট্রির নিয়ন্ত্রণমুক্ত এমন একটা গণসমাজ তৈরি হতে পারে, যা নিজের ‘সাংস্কৃতিক’ চাহিদা পূরণ করতে নিজের বুঝমতো ‘আর্ট-কালচার’ বিকশিত করতে পারে। দরকার বাজারি মিডিয়ার বৈধতার সংকটকে সামনে আনা। দরকার ‘পপুলার’ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধও। তা না হওয়া পর্যন্ত চলবে ‘মিডিওক্রেসি’র জয়জয়কার। সেটা, শেষ পর্যন্ত কারও জন্যই সুখবর নয়।