সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
আসমুদ্র হিমাচল যাঁর কণ্ঠস্বরে প্লাবিত, যাঁর গান ও সুরে তিন প্রজন্মের মানুষ মোহিত হয়েছে, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেন। বলিউডের হেমন্তকুমার, আর বাংলার হেমন্ত। একই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। বাঙালির কাছে হেমন্তকালের হিমেল হাওয়ার প্রাণজুড়োনো পরশের মতো ‘হেমন্ত কণ্ঠ’ যেন জ়ীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে এক সঞ্জীবনী সুধা। যা অনাবিল প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে জীবনের চরম, কঠিন, সঙ্কটময় মুহূর্তেও।
তাঁর জন্মশতবর্ষে রইল ১২ টি জানা–অজানা তথ্য। বেশ কয়েকটা হয়ত জানা। কোনওটা হয়ত অজানা।
১. বাংলায় প্রথম বেসিক গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯৩৭ সালে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে। শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুর এবং নরেশ ভট্টাচার্যের কথায় গানটি ছিল ‘জানিতে যদি গো তুমি’। আর তাঁর নিজের সুরারোপিত প্রথম বেসিক গান ১৯৪৩ সালে অমিয় বাগচীর কথায়। ‘কথা কোয়ো নাকো, শুধু শোনো’।
২. প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪৪ সালে ‘আমার আর হবে না দেরী’। বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রগান প্রথম গেয়েছিলেন ১৯৪২ সালে ‘অপরাধী‘ ছবিতে। গানটি ছিলো ‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’।
৩. বাংলা ছবিতে প্রথম প্লে ব্যাক ১৯৪০ সালে। ‘নিমাই সন্ন্যাস’ছবিতে, ছবি বিশ্বাসের লিপে। গীতিকার ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য এবং সুরকার ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস।
৪. নিজের সুরে প্রথম বাংলা ছবিতে গান ১৯৪৭ সালে ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে। এখানে তাঁর সহধর্মিণী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি দ্বৈতকণ্ঠে গান ছিল।
৫. প্রথম হিন্দি ছবিতে প্লে ব্যাক করেছিলেন ১৯৪২ সালে, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুরে ‘মীনাক্ষী’ ছবিতে। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ আরও দশ বছর পর। নিজের সুরারোপিত প্রথম হিন্দি ছবি ১৯৫২ সালে ‘আনন্দমঠ’। এই ছবিতেই লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম’ যা সারা ভারতবর্ষে আজও সমধিক জনপ্রিয়।
৬. মহানায়ক উত্তমকুমারের লিপে সবচেয়ে বেশি ছবিতে গান করেছিলেন। ছবির সংখ্যা ৩০ টি। প্রথম প্লে ব্যাক ১৯৫১ সালে ‘সহযাত্রী’ ছায়াছবিতে। তার পরে ১৯৫৫ সালে নিজের সুরারোপিত ‘শাপমোচন’ ছবি দিয়ে বাংলায় উত্তম–হেমন্ত জুটির জয়যাত্রা শুরু যা প্রায় ২৫ বছর ধরে চলেছিল। উত্তম কুমারের লিপে সর্বশেষ প্লে ব্যাক ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত (উত্তমকুমারের প্রয়াণের পরে) ‘খনা বরাহ’ ছবিতে। এখানে একটি স্তোত্র বা সংস্কৃত শ্লোক ছিল হেমন্ত কন্ঠে।
৭. মোট ১৩৮ টি বাংলা ছায়াছবিতে সুরারোপ ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুরারোপিত প্রথম ছায়াছবি ‘পূর্বরাগ’-(১৯৪৭) এবং শেষ ছবি তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আগমন’ (১৯৮৮)।
৮. বলিউডে তাঁর সুরারোপিত ছবির সংখ্যা ৫৪। প্রথম ছবি ‘আনন্দমঠ’-(১৯৫২)। শেষ সুরারোপ সদ্যপ্রয়াত বাসু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালিত ‘দো লড়কে দোনো করকে’ (১৯৭৯)।
৯. বাংলা এবং হিন্দি ছাড়াও দুটি ভোজপুরি ও একটি মারাঠি ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ভোজপুরি ছায়াছবি দুটির নাম ছিল ‘আয়েল বসন্ত বাহার’-(১৯৬৩) এবং বালমা বড়া নাদান-(১৯৬৪)। আর মারাঠি ছবিটির নাম ‘নায়িকিঞ্চি সাজ্জা’-(১৯৫৭)। সুরারোপ ছাড়াও মারাঠি, গুজরাটি, ওড়িয়া, তামিল, অসমীয়া, ভোজপুরি, কোঙ্কনী এবং পাঞ্জাবি ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষায় তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন।
১০. হেমন্তের সুরের খেয়া দেশের বাইরে সুদূর আমেরিকাতেও পৌঁছেছিল। ১৯৭২ সালে প্রখ্যাত মার্কিনী চলচ্চিত্রকার কনরাড রুকস নির্মাণ করেছিলেন ‘সিদ্ধার্থ’ ছায়াছবি। যার সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই কৃতিত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনিই ভারতের প্রথম কণ্ঠশিল্পী যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন।
১১. ২ টি বাংলা এবং ৮ টি হিন্দি ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। বাংলাতে একটি ছায়াছবি পরিচালনাও করেছিলেন। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত এবং প্রযোজিত ছবি ‘অনিন্দিতা’, যা আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। তাঁর প্রযোজিত প্রথম বাংলা ছায়াছবি মৃণাল সেনের পরিচালনায় নির্মিত ‘নীল আকাশের নীচে;-(১৯৫৯)। আর হিন্দি ছবির জগতে তাঁর প্রযোজিত ছবির সংখ্যা ৮ । এগুলি হল বিশ সাল বাদ, কোহরা, ফারার, মঝলি দিদি, বিবি আউর মাকান, রাহগীর, খামোশী এবং বিশ সাল পেহেলে।
১২. সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে ‘নাগিন’ ছবির জন্য। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে ‘নিমন্ত্রণ’ এবং ১৯৮৬ সালে ‘লালন ফকির’ ছবিতে প্লে ব্যাক করার সুবাদে। আর BFJA পুরস্কার পেয়েছিলেন মোট ১২ বার। তার মধ্যে ৯ টি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এবং ৩ টি নেপথ্য গায়ক হিসেবে। ১৯৮৫ সালে রবীন্দ্রগানে বিশ্বভারতীর সাম্মানিক ডি-লিট, ১৯৮৬ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার পেয়েছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী।