নরম রোদ গায়ে মেখে রাজাভাতখাওয়া

হৈমন্তী ঘোষাল

দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনী লিখতে পারি না। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি ভাগ করে নিতে পারি।

রাজাভাতখাওয়া আমার খুব প্রিয় জায়গা। অথচ, প্রথমবার এই জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে কোনও উৎসাহই ছিল না। ঠিক ছিল, জয়ন্তীতে থাকব। সেখানে জায়গা পেলাম না। ঠাঁই হল, রাজাভাতখাওয়ায়। ইসস, জয়ন্তীতে থাকতে পেলাম না!‌ মনটা খচখচ করছিল। সেই আক্ষেপ নিয়েই বিকেলে ঘুরতে বেরোলাম। একেবারে পায়ে হেঁটে।

প্রথমেই বলে রাখি ওই প্রান্তিক স্টেশনটার কথা। যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন। ওখানে বসে থাকলেই মন জুড়িয়ে যায়। সারা দিন হাতে গোনা কয়েকটা ট্রেন যায়। ফলে, জঙ্গলঘেরা একেবারেই শান্ত একটা স্টেশন। এখানে কিন্তু মাইকে ঘোষণা হয় না। এখনও ঘণ্টা বাজে। একটা অন্য রকমের ভাল লাগা।

dooars5

স্টেশনের গায়েই ছোট্ট একটা ভাতের হোটেল। বুলুদার দোকান। একবার ঢুকে পড়ুন। দেখুন, আতিথেয়তা কাকে বলে। গরম গরম ভাত, বোরোলি বা দেশি মুরগি। মন ভাল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

পায়ে হেঁটে একটু চক্কর কাটুন। ইংরেজ আমলের কাঠের বাংলো। পাশেই সরকারি জঙ্গল লজ। ভেতরটা দারুণ সাজানো গোছানো। স্টেশনের একদিকে ছোট্ট একটা গ্রাম্য বাজার। রেল ক্রসিং পেরিয়ে জঙ্গলঘেরা রাস্তা ধরে একটু আলতো করে হেঁটে আসা এক দারুণ অনুভূতি। এখানে জন্তু জানোয়ারদের তেমন ভয় নেই। অথচ, জঙ্গলের রোমাঞ্চ আছে পুরোমাত্রায়। বিশাল বিশাল প্রাচীন সব গাছ। যত দূর খুশি হেঁটে যান। যেখানে গিয়ে মনে হল, আর পারছেন না, বসে পড়ুন। ফেরার অটো ঠিক পেয়ে যাবেন। অলসভাবে হাঁটতে হাঁটতে কোনও চায়ের দোকানে বসে পড়ুন। চা, অমলেটের সঙ্গে মোমো বা ওয়াই ওয়াই দিব্যি খেয়ে নিতে পারেন। দোকানে, রেস্তোরাঁয় তো অনেক খেয়েছেন। জঙ্গলের ধারের ওই ছোট্ট গুমটি। বাইরে কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসে সকাল বা বিকেলের টিফিনটা মন্দ নয়।

চেকপোস্ট থেকে একটা অটো নিয়ে ঘুরে আসুন এক সাধুবাবার মন্দিরে। কাছেই, মিনিট পাঁচেক। সাধুবাবা সেখানে একাই থাকেন। হাতি আসে, চিতাবাঘ আসে। কোনও ভয়ডর নেই। তিনি দিব্যি আছেন। কাছেই ওয়াচ টাওয়ার। সেই ওয়াচ টাওয়ারে হাতিরা পিঠ ঘসে। সিঁড়ি ধরে উঠে যান। একনজরে দেখে নিন জঙ্গলের চারপাশটা। চাইলে, সাধুবাবার সঙ্গে একটু গল্পও করতে পারেন। খুব রসিক মানুষ। পুরনো দিনের কত কথা, হাতিদের কথা শুনতে পাবেন। দেখতে একেবারে শীর্ণকায়। শেষ কবে ভাত খেয়েছেন, নিজেও জানেন না। আশপাশের সবাই যে তাঁকে খুব ভক্তি করে, একটু দাঁড়ালেই বোঝা যায়। কত লোক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। প্রণাম করে যাচ্ছে। ফল মূল দিয়ে যাচ্ছে।

জঙ্গলের মাঝে ওই সাধুবাবার আশ্রম যেন অন্য এক তৃপ্তি দিয়ে যায়। এত হাতির আনাগোনা। সাধুবাবা কী নিস্পৃহ। হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দেন। তাদের সঙ্গে গল্প করেন। সেই হাতিরাও দিব্যি এই সাধুবাবার ভাষা বোঝে। দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়। পালাতে বললে পালায়।

সন্ধে নামছে। সেই জঙ্গলের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি। গুনগুন করে গান ধরতে ইচ্ছে করছে। সবমিলিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। পরদিন খুব ভোরে উঠে আবার সেই একই রাস্তায়। জঙ্গলের বুকে আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে। গাছের ফাঁক দিয়ে আলতো আলো এসে পড়ছে। সবমিলিয়ে দারুণ এক অনুভূতি। এই লকডাউনের সময় সেই স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.