উন্মাদনার ইডেন, হাহাকারের ইডেন

শুভ্রাংশু চ্যাটার্জি

বারো বছর পর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। বাড়তি একটা উন্মাদনা থাকবেই। তার ওপর শুরু থেকেই ভারত ছুটছে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো। সব ম্যাচে জিতে লিগ টেবিলের শীর্ষে। সেমিফাইনালে যাওয়া আগেই নিশ্চিত। ফলে, উন্মাদনা আরও বেশি।

উন্মাদনা বেশি হলে টিকিটের চাহিদা বাড়বে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। টিকিটের চাহিদা বাড়লে টিকিটকে ঘিরে কালোবাজারিও শুরু হয়ে যায়। এই ইডেনে কালোবাজারি নতুন কিছু নয়। ময়দানের আনাচে কানাচে কম দামের টিকিট বেশি দামে বিক্রি হতে আগেও দেখা গেছে।

কিন্তু এবারের কালোবাজারি যেন অতীতে সব কলঙ্ককে ছাপিয়ে গেল। এটা মোটেই গৌরবের বিজ্ঞাপন নয়। কিন্তু যেটা ঘটনা, সেটা ঘটনাই। নশো টাকার টিকিট দশ হাজারেও বিক্রি হয়েছে। টিকিটের হাহাকার এমন স্তরে পৌঁছল, সিএবি ও বিসিসিআই–‌এর বিরুদ্ধে থানায় একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ল। সিএবি সভাপতিকে থানায় তলব করা হল। বিসিসিআই সভাপতি বা তাঁর প্রতিনিধিকে হাজির হওয়ার নোটিশ পাঠানো হল। অনলাইন টিকিট বিক্রির দায়িত্বে যে সংস্থা, তাদেরও দফায় দফায় জেরা করা হল। ইডেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ইডেনে হয়েছে। কিন্তু টিকিটকে ঘিরে এমন হাহাকার এবং এমন অনিয়মের ছবি আগে ধরা পড়েনি।

কিন্তু পরিস্থিতি কেন তৈরি হল?‌ টিকিটের এত চাহিদাই বা কেন?‌ প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক ও প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির দাবি, ‘‌দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। ভারত দারুণ খেলছে। উন্মাদনা তো হবেই। ভারত ফাইনালে উঠলে আমেদাবাদের একলাখি স্টেডিয়ামকেও তখন ছোট মনে হবে।’‌ তিনি তাঁর মতো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের দেশে গণ উন্মাদনার কথাই তুলে ধরেছেন। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, টিকিট বণ্টনে স্বচ্ছতার অভাবেই এমন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। কোনও সংস্থাই নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেনি। সবাই দায় এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছেন। সেই কারণেই সুষ্ঠুভাবে এই আয়োজন করা যায়নি।

বড়সড় অভিযোগ উঠছে অনলাইন টিকিট বণ্টনকে ঘিরে। অনেকেই টিকিট কাটতে গিয়ে দেখেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটি, টিকিট কাটাই যাচ্ছে না। অল্প সময়ের পরেই কার্যত নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘‌সোল্ড আউট’‌। অর্থাৎ, সব টিকিট শেষ। সত্যিই কি শেষ?‌ নাকি এজেন্ট মারফত সেই টিকিটের কিছু অংশ সরিয়ে রেখে ঘুরপথে কালোবাজারি হয়েছে?‌ অনেকের মনেই প্রশ্ন থেকে গেছে। সিএবি কর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‌নশো টাকার টিকিট নশো টাকায় বিক্রি করে যা লাভ, ঘুরপথে যদি বেশি টাকায় বিক্রি হয়, তাহলে লাভ অনেক বেশি। এটাই অর্থনীতির সহজ অঙ্ক।’‌

একসময় এই ইডেনেও প্রায় এক লাখ দর্শকের সমাগম হত। কিন্তু নানা সংস্কারের পর, আসন সংখ্যা কমে এখন হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার। এর মধ্যে কোন প্রক্রিয়ায় কত টিকিট বণ্টন হয়েছে, তার কোনও স্পষ্ট হিসেব সরকারি স্তরে দেওয়া হয়নি। সেই কারণেই অসচ্ছ্বতার অভিযোগ আরও বেড়েছে। কত টিকিট অনলাইনে, কত টিকিট অনুমোদিত ক্লাবকে, কত টিকিট কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে দেওয়া হয়েছে, তার স্পষ্ট কোনও হিসেব সিএবি কর্তারাও দিতে পারেননি। পুলিশ সূত্রে এবং বেসরকারি সূত্রে কিছু হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। তা মোটামুটি এরকম— অনলাইনে বিক্রি ১৮ হাজার। অনুমোদিত ক্লাব ও সংস্থা পেয়েছে প্রায় ২৬ হাজার। কমপ্লিমেন্টারি ১৮ হাজার।

লাইফ মেম্বার, অ্যানুয়াল মেম্বার, অ্যাসোসিয়েট মেম্বার— নানা পর্যায় মিলিয়ে সিএবি–‌র সদস্য সংখ্যা প্রায় এগারো হাজার। সদস্যরা বিনামূল্যে একটি করে টিকিট পেয়ে থাকেন, এটাই প্রথা। কিন্তু এবার এগারো হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র তিন হাজার সদস্য টিকিট পেয়েছেন। ফলে, অধিকাংশ সদস্যই টিকিট পাননি। তাঁদের বড় একটা অংশ ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যেই ইডেনের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁদেরই কেউ কেউ থানায় এফআইআর–‌ও করেছেন। তাঁদের দাবি, ‘‌ইডেনে খেলা হলে একটা টিকিট পাব, সেই আশাতেই সিএবি–‌র সদস্য হয়েছি। প্রতি বছর মোটা অঙ্কের চাঁদা দিই। সেই টিকিট না দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হল।’‌ যদিও সিএবি–‌র ব্যাখ্যা, ‘‌যেসব ম্যাচ আমরা আয়োজন করি, সেইসব ম্যাচে সব সদস্যকেই টিকিট দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বকাপ আইসিসি–‌র প্রতিযোগিতা। তাদের নিয়ম মেনেই টিকিট বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে আমরা অসহায়।’‌

আসলে, একটি টিকিট শুধু খেলা দেখার ছাড়পত্র নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক কিছু। একটি টিকিট মানে, একটা সামাজিক সম্মান, একটা আবেগ। তিনি ইডেনের টিকিট পান, এটা অনেকের কাছেই একটা আত্মমর্যাদার প্রতীক। পাড়ায়, অফিসে, পরিবারে, আত্মীয়দের মাঝে এটাই তাঁর সামাজিক মর্যাদা অনেকটা বাড়িয়ে তোলে। সেই টিকিট না পেলে, সেই মর্যাদাও কোথাও একটা ক্ষুণ্ণ নয়। অনেক সময় তিনি নিজে হয়ত খেলা দেখতে যান না। অন্য কাউকে দিতে পারেন। সেই টিকিট নেওয়ার জন্য অনেকেই দরবার করেন। হয়ত নিজের জামাইকে বা আদরের নাতিকে দেবেন বলে কথাও দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি নিজেই টিকিট না পেলে অন্যকে দেবেন কীভাবে? তাঁর মনে হতেই পারে, তিনি অসম্মানিত হলেন।

সিএবি অনুমোদিত বিভিন্ন ক্লাব টিকিট পেয়ে থাকে। বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থাও টিকিট পেয়ে থাকে। কিছু কমপ্লিমেন্টারি। আবার কিছু প্রাইস টিকিট। যার জন্য লাইন দিতে হয় না। অনেকেই সেখান থেকে টিকিট তুলতেন। কিন্তু এবার সেই টিকিটের পরিমাণও অনেকটাই কম। ফলে, সেইসব ক্লাবের খেলোয়াড় বা কর্তারা যে টিকিট পেতেন, তাঁদের অনেকেই পাননি। সূত্রের দাবি, দেশের হয়ে দীর্ঘদিন খেলা এক প্রাক্তন ক্রিকেটারও নাকি টিকিট পাননি। আবার বিভিন্ন সংস্থার অভিযোগ, টাকা দিয়ে যে টিকিট তুলতে হয়, সেই টিকিটের নোটিশ দেওয়া হয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তে। তখন সেই টিকিট সংগ্রহ করা, সদস্যদের মধ্যে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না। তাই অনেক সংস্থা টিকিট তুলতেও পারেনি। অনেক আগে থেকেই সিএবির বিভিন্ন সভা উত্তপ্ত হয়েছে। টিকিট নিয়ে তুমুল বিতণ্ডার খবরও সামনে এসেছে।

এবার কমপ্লিমেন্টারি। এই টিকিট কোথায়, কীভাবে বণ্টন হয়েছে, তা নিয়ে আগাগোড়াই অন্ধকারে বিরাট অংশের মানুষ। এই টিকিটের কিছুটা ঘোষিত ভাবেই যায় বিভিন্ন সংস্থায়। তবে এই টিকিট বণ্টনের অনেকটা আড়ালে থেকে যায়। কোন কোন প্রভাবশালীর কাছে যায়, তা বরাবরই আড়ালে থেকে যায়। সামনে আনা হয় না। সূত্রের দাবি, অনেক গোপন খাম তৈরি থাকে। সেইসব খাম ঠিক জায়গায় পৌঁছেও যায়। যার কোনও সরকারি হিসেব থাকে না।

আসলে, এই কমপ্লিমেন্টারি টিকিটের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে একটা সোশ্যাল স্টেটাস বা সামাজিক মর্যাদা। আমি কমপ্লিমেন্টারি টিকিটে খেলা দেখি, এটা অনেকের কাছেই দারুণ একটা শ্লাঘার বিষয়। সেই টিকিট তিনি দীর্ঘদিন পকেটে রেখে দেন, নানা লোককে দেখিয়ে বেড়ান। নিজেকে ভিআইপি ভেবে গর্ব করেন। এমনও অনেকে আছেন যাঁরা টাকা দিয়ে কমপ্লিমেন্টারি টিকিট কেনেন। শুধুমাত্র সেই টিকিট অন্যদের দেখাবেন বলে।

যাঁরা মাঠে ভীড় করেন, তাঁদের সবাই কি দারুণ ক্রিকেটপ্রেমী?‌ তাহলে, এই ইডেনেই এক সপ্তাহ আগে যে দুটি ম্যাচ হল, সেই ম্যাচে গ্যালারির অর্ধেক ফাঁকা রইল কেন?‌ সেই ম্যাচে তো টিকিটকে ঘিরে চাহিদা তৈরি হল না। এমনকী, এই ইডেনেই রয়েছে বিশ্বকাপের একটি সেমিফাইনাল। ভারত যদি না খেলে, তাহলে কি স্টেডিয়াম ভরবে?‌ তাহলে কি টিকিটের এই হাহাকার থাকবে?‌ এমনকী ভারত যখন এই ইডেনেই টেস্ট খেলে বা সাধারণ কোনও ওয়ান ডে খেলে, তখন কি এই চাহিদা থাকে!‌ গ্যালারি ভর্তি হয়?

আসল কথা হল বিশ্বকাপ। তাই এই উন্মাদনা। আরও একটা বড় কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া। আমি ইডেনে বসে নীল জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচ দেখছি, ‌এই ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার তীব্র একটা নেশা। মাঠে যাঁরা হাজির হচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই কম–‌বেশি নেই নেশায় আক্রান্ত। তাঁদের ফেসবুকে উঁকি মারলেই বোঝা যাবে। সিএবি–‌র এক কর্তা মজা করে বললেন, ‘‌মোবাইল নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিন। দেখুন, সত্তরভাগ লোক আর টিকিট চাইবে না।’‌
***********

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.