ব্যাট হাতে মাঠে যখন খেলতে নামেন ভিভ.‌.‌

স্বরূপ গোস্বামী

ক্রিকেটে আমার প্রিয় দল কোনটি?‌ নিশ্চিতভাবেই ভারত। কিন্তু আটের দশকে যদি কেউ এই প্রশ্নটা করত, হয়ত একটা অন্যরকম উত্তর দিতাম। কারণ, তখন আমি ভারতের জয় যত না চাইতাম, তার থেকে বেশি চাইতাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়।

পচাত্তর বা উনআশির বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ হয়নি। এমনকী তিরাশিতেও না। কিন্তু তারপর থেকেই একটু একটু করে ক্রিকেট বোঝা। ততদিনে জেনেছি, প্রথম দুবার এই দলটিই বিশ্বকাপ জিতেছে। তিরাশিতে এই ক্যারিবিয়ানদের হারিয়েই বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত।

কলকাতার জীবন আর মফস্বল জীবনে তখন ঢের ফারাক। কলকাতা যখন তিরাশির বিশ্বকাপের স্মৃতির ঢেঁকুর তোলে, মফস্বল সেখানে অনেকটাই পিছিয়ে। তিরাশিতে অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎটুকুও পৌঁছয়নি। যেসব মফস্বল বা আধা শহরে পৌঁছেছে, সেখানেও হাতে গোনা কয়েকটা ঘরে টিভি। তাছাড়া তখনও ক্রিকেটের তেমন চল ছিল না। মফস্বল জীবন তিরাশিকে চিনেছে তিরাশির অনেক পরে। সেই জীবনে বিশ্বকাপের অভিষেক বলতে ছিয়াশির মারাদোনা। আর ক্রিকেটের বিশ্বকাপ বলতে, তার ঠিক এক বছর পর, সাতাশি। সেবার ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ। পাড়ায় পাড়ায় টিভি কেনার ধুম। সেই প্রথম টিভি নামক বস্তুটা উচ্চবিত্তের বেড়া টপকে মধ্যবিত্তের বারান্দায় এসে পড়ল। তবু এক ঘরের বারান্দায় পড়শিদের, বন্ধুদের ভীড়। ছাদে টাঙানো অ্যান্টেনা, হাওয়া দিলেই নড়ে যায়। একজন ছুটল ছাদে, এদিক–‌ওদিক ঘোরাল। অন্যজন নিচ থেকে চিৎকার করল, ‘‌আরেকটু, আরেকটু। হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে।’‌

সে ছিল এক সাদা–‌কালো টিভির রঙিন এক ভুবন। সবুজ ঘাস, লাল বল— এসবের আলাদা কোনও অস্তিত্ব ছিল না। টিভির পর্দায় নয়, সব রঙ তখন মনের পর্দায়। ভারত নামে একটা দেশ, যারা আগেরবার বিশ্বকাপ জিতেছে। ওদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’‌বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিরাশিতে নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে ফিরে এসে রানার্স হয়েছে। এবার নিশ্চয় বদলা নেবে!‌ কিন্তু সেই লয়েড নেই। হোল্ডিং, গারনার, রবার্টসরা নেই। মার্শালও নাকি চোটের জন্য খেলবেন না। এমনকী গর্ডন গ্রিনিজও নেই। তবু দলটার নাম তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আগেরবার হারের যন্ত্রণা। তারা কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে!‌

ভারত শুরুই করল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হার দিয়ে। তাও আবার মাত্র এক রানে। ওদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীলঙ্কাকে জাস্ট উড়িয়ে দিল। ভিভ রিচার্ডস কিনা ১৮১ করে দিল!‌ আমাদের কপিলদেবের সাধের ১৭৫ এর রেকর্ড ভেঙে চুরমার। এত নির্দয়ভাবে কেউ মারে!‌ আহা, শ্রীলঙ্কা বলে কি মানুষ নয়!‌ ওরাও তো খেলতে এসেছে। লোকটা মনের সুখে চুইং গাম চিবোচ্ছে, আর দুমদাম ছয় মারছে। আবার ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে চুইং গাম চিবোচ্ছে। কাগজে একটা ছড়া পড়লাম—
‘‌ব্যাট হাতে মাঠে যখন
খেলতে নামেন ভিভ,
‌স্বর্গ মর্ত্য কাঁপে তখন
কাঁপেন বাবা শিব।’‌
ছড়াটা নিমেশে মুখস্থ হয়ে গেল। বহুদিন যেখানে–‌সেখানে, কারণে–‌অকারণে আউড়ে ছিলাম। কপিলের রেকর্ড ভেঙে গেল বলে দুঃখ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কেন জানি না, মনে হল, এই রেকর্ডের মুকুট বোধ হয় রিচার্ডসের মাথাতেই মানায়। ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে, চুইং গাম চিবোতে চিবোতে ভিভিয়ান রিচার্ডস। আহা, সে কী রাজকীয় ঔদ্ধত্য। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিলেন। আলতো একটা ছোঁয়া দিলেন। বল যেন ছুটে গেল মাঠের বাইরে। তারপর আবার সেই ব্যাট ঘোরাতে ঘারোতা চুইং গামে মন দেওয়া। যেন কিছুই হয়নি।

তিরাশিতে তাঁর আউটের দৃশ্যটা পরে বারবার দেখেছি। মনে হয়েছে, ভারতের প্রতি যেন কিছুটা করুণাই করলেন। রাজকীয় সংহারের পর যেন একটু আলসেমি। যা, ক্যাচ তুলে দিলাম। পারলে নিয়ে নে। আমরা তো দু’‌বার বিশ্বকাপ জিতেছি। এবার অন্য কেউ পেলে পাক। ক্রিকেটের সম্রাট বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি ভিভ রিচার্ডস। তাঁর থেকে বেশি রান বা সেঞ্চুরি অনেকেই করেছেন। তাঁর থেকেও কম বলে সেঞ্চুরিও অনেকে করেছেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই রিচার্ডসের আশেপাশে বসানো যায় না। ভিভ মানেই কৈশোরের সেই মুগ্ধতা। ভিভ মানেই একটা অলস আভিজাত্য। ভিভ মানেই একটা রাজকীয়তা। যারা তা দেখেনি, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তারা ক্রিক ইনফো খুলে কিছু নীরস স্ট্যাটিস্টিক্স দেখুন। ওই পরিসংখ্যানগুলো আসলে কিছুই নয়। সাধে নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড একটা আস্ত গাধা!‌ স্মার্টফোন, ইন্টারনেট শব্দগুলো তখন যেন আলোকবর্ষ দূরে। তখন ভাল লাগের প্রকাশ মানে কাগজে বেরোনো সেই তারকাদের ছবি কেটে খাতায় বা দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া। ফেসবুকের দেওয়ালের থেকে সেই দেওয়াল কোনও অংশে কম রোমাঞ্চকর ছিল না।

বল হাতে কখনও ছুটে আসছেন ম্যালকম মার্শাল, কখনও জোয়েল গার্নার, কখনও অ্যান্ডি রবার্টস। পরের দিকে সেটা দাঁড়াল প্যাটারসন, ওয়ালসে। তারও পরে কোর্টলে অ্যামব্রোজ। সবথেকে ভাল লাগত কোর্টনি ওয়ালসকে। মনে পড়ে যাচ্ছে, সাতাশির বিশ্বকাপের একটি ঘটনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলা। ১ বলে চাই ২ রান। বল করছেন ওয়ালস। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে সেলিম জাফর। ওয়ালস আম্পায়ারের কাছে আসতেই জাফর অনেকটা এগিয়ে গেছেন। চাইলেই রান আউট করতে পারতেন ওয়াসলস। কিন্তু রান আপ থামিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। জাফরকে ফিরে আসতে বললেন।

জাফর ফিরে এলেন। শান্ত পায়ে ওয়ালস আবার ফিরে গেলেন বোলিং মার্কে। বলাই বাহুল্য, শেষ বলে দুই রান তুলে নিয়েছিলেন আব্দুল কাদির। হারতে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ছিটকে গিয়েছিল সেমিফাইনালের আগেই। কিন্তু কেন জানি না, দলটাকে ভাল লেগে গেল। প্রেমে পড়ে গেলাম ওয়ালসের। ক্রিকেট নাকি ভদ্রলোকের খেলা। সত্যিই, সেদিন চূড়ান্ত ভদ্রতাই দেখিয়েছিলেন ওয়ালস। অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল ক্রিকেট।

পরের বিশ্বকাপ গুলোর কথা আর লিখছি না। কারণ, পরের বিশ্বকাপের আগে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ভিভ রিচার্ডস নাকি টিম থেকে বাদ। এমন সিদ্ধান্ত কোন আহাম্মক নিলেন, কিশোর মনে এই প্রশ্নটাই বারবার ঝড় তুলেছিল। সময় এগোলো নিজের নিয়মে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের গৌরব অনেকটাই হারিয়ে ফেলল। ততদিনে তাদের সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন বলে ভাবাও হচ্ছিল না। ওয়ালস, অ্যামব্রোজ, হুপাররা তো ছিলেনই। এসে গিয়েছিলেন ব্রায়ান লারার মতো কিংবদন্তিও। তবু সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন অতীতের ছায়া। তলিয়ে যেতে যেতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সোনালি সেই অতীত। তবু কী করে ভুলব সেই কৈশোরের অনুরাগ!‌ কী করে ভুলব, রিচার্ডসের ছবি কেটে সেই দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া!‌

নিজের প্রিয় দল বিশ্বকাপের আঙিনাতেই থাকবে না!‌ এমন একটা নির্মম বাস্তব কী করে হজম করি!‌

‌‌‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.