বাইশ বছর আগের কথা। একজন বাঁহাতিকে খুব মনে ধরেছিল নির্বাচকদের। রনজি ফাইনালের আগে তাঁরা হাজির হয়ে গেলেন কলকাতায়। ইচ্ছে, সেই শিল্পী ব্যাটসম্যানকে আরও কাছ থেকে একটু দেখা।
দেখলেন, তবে অন্য এক বাঁহাতিকে। সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা সেই ছেলেটি রান করল ২২। রানের নিরিখে হয়তো আহামরি কিছু নয়। কিন্তু ছোট্ট ইনিংসটাই বুঝিয়ে দিল, বাইশ গজে এই ছেলে লম্বা রেসের ঘোড়া।
কিন্তু যাঁকে দেখতে এসেছিলেন, সেই বাঁহাতি শিল্পী ব্যাটসম্যানের কী খবর? স্কোরবোর্ড খুললে তাঁকে পাওয়া যাবে না। কারণ, তাঁকে বাদ দিয়েই ফাইনালে অভিষেক হয়েছিল তরুণ তুর্কি বাঁহাতির। বাদ যাওয়া সেই ক্রিকেটারের নাম স্নেহাশিস গাঙ্গুলি। আর ফাইনালে নাটকীয়ভাবে সুযোগ পাওয়া সেই ক্রিকেটার হলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ম্যাচের আগের রাতে একবার শুধু বেহালার গাঙ্গুলি বাড়ির অবস্থাটা ভাবুন। ছোট ছেলে রনজি ফাইনালে সুযোগ পেয়েছে। আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা। কিন্তু বাড়ি জুড়ে শুধুই একটা থমথমে আবহ। কারণ, বাদ পড়েছেন বড় ছেলে।
সেই অভিষেক মুহূর্ত থেকে শুরু। নানা বাঁকে এমনই ঘটনাবহুল কত উপাদান। যিনি বায়োপিক বানাবেন, তিনি কোথায় শুরু করবেন, কোথায় কতটুকু আলো ফেলবেন, হিসেব মেলানো কঠিন। আজ সেই মানুষটাই পা দিচ্ছেন জীবনের হাফসেঞ্চুরিতে।
রনজি অভিষেক থেকে কাট টু। লর্ডসে টেস্ট অভিষেক। দলের যা কম্বিনেশন, সেবারও জায়গা হওয়া কঠিন। মাথা গরম করে ভোর রাতে হোটেল ছেড়ে চলে গেলেন সিধু। চোটের জন্য শেষমুহূর্তে ছিটকে গেলেন সঞ্জয় মঞ্জরেকার। দরজা খুলে গেল এক বঙ্গসন্তানের। তারপর এক ইতিহাস। শুরুর আগেও তো শুরু থাকে। একদিনের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিমানে উড়েছিলেন চার বছর আগে (১৯৯২)। সে বড় সুখের সময় নয়। রটে গেল, তিনি উদ্ধত, টিমম্যান নন। পরের চার বছর এই তকমাই বয়ে বেড়াতে হল। সেও ছিল এক কামব্যাক। যা নিয়ে তেমন চর্চা হয় না।
সেই ছেলে কিনা দেশের অধিনায়ক! ইডেনে স্টিভের অশ্বমেধের ঘোড়া থামাচ্ছেন! লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালে জার্সি ওড়াচ্ছেন! দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফাইনালে টস করতে যাচ্ছেন! সব আঞ্চলিকতার গণ্ডি ভেঙে একঝাঁক তরুণ তুর্কিকে নিয়ে ‘টিম ইন্ডিয়া’ বানাচ্ছেন! কীর্তির মাইলফলক সুবিস্তৃত। বাদ গিয়ে দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে সেই মানুষটাই জন্ম দিচ্ছেন ‘রূপকথার কামব্যাক’ উপাখ্যানের। সিএবি–র সচিব–সভাপতির গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই লোকটাই পৌঁছে যাচ্ছেন বোর্ডের সর্বোচ্চ আসনে। এরই ফাঁকে কখনও দাদাগিরি, কখনও ধারাভাষ্য। কখনও ৩৮ খানা ব্র্যান্ডের এন্ডোর্সমেন্ট তো কখনও করোনা আবহে নিঃশব্দে দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানোর বিরাট কর্মকাণ্ড। এরই মাঝে কত রাজনৈতিক জল্পনা। অনেকে বলেন, পা বাড়িয়ে অফস্টাম্পের বাইরের বলটাকে ছেড়ে দিলেন। আসলে, স্টেপ আউট করে জল্পনাটাকে গ্যালারিতেই পাঠিয়ে দিলেন। একই অঙ্গে কত ভিন্ন সত্ত্বার স্রোত। সব সত্ত্বাকে ছাপিয়ে আসলে তিনি এক মহাজীবনের শিক্ষক।