স্বরূপ গোস্বামী
ভরদুপুরে হাপপ্যান্ট আর জার্সি পরে মুম্বইয়ের রাস্তায় শচীন তেন্ডুলকার হেঁটে যাচ্ছেন। বা ধরা যাক, একই পোশাকে কলকাতার রাস্তায় সৌরভ গাঙ্গুলি হেঁটে যাচ্ছেন। শুনে অবাক লাগছে? আটের দশকে কিন্তু এভাবেই হেঁটে যেতেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। সময়টা ১৯৮৭। তার তিন বছর আগেই বুট, জার্সি সযত্নে তুলে রেখেছেন এই শিল্পী ফুটবলার। তিন বড় ক্লাব মিলিয়ে ১২ বছর খেলা হয়ে গেছে। পরপর পাঁচ বছর বাংলাকে সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন করা হয়ে গেছে। দেশের জার্সিতে দু’বার এশিয়ান গেমস খেলাও হয়ে গেছে।
অফিস, পরিবার, গান, নাটক, সাহিত্য–এসব নিয়ে নিশ্চিন্তে অবসর জীবন কাটানোর কথা। ঠিক এমন সময় হঠাৎ জর্জ টেলিগ্রাফের কোচ হয়ে এলেন সুভাষ ভৌমিক। আবদার করে বসলেন, সুরজিৎকে চাই। তাঁর না হয় নতুন কোচিং জীবন। দু’চোখে না হয় অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সুরজিৎ তো তিন বছর আগেই কলকাতা ময়দানকে গুডবাই জানিয়ে রেখেছেন। তিনি খামোখা ছোট দলের জার্সিতে খেলতে যাবেন কেন? ওদিকে, সুভাষও নাছোড়বান্দা, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সুরজিৎকেই চাই।’
ওদিকে, সুরজিতের অবস্থা ভাবুন। সোনালি অতীতকে পেছনে ফেলে এসেছেন। তাঁর পক্ষে আবার ফিরে আসা সম্ভবয় তাও আবার ছোট দলের জার্সিতে! তবু চ্যালেঞ্জটা নিলেন। সই করলেন জর্জ টেলিগ্রাফে। মিশে গেলেন আর দশজন জুনিয়র, অখ্যাত ফুটবলারদের সঙ্গে। খেলার আগে জর্জ তাঁবুতে পৌঁছনো। জার্সি গায়ে বাকিদের সঙ্গে দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে কখনও কালিঘাট মাঠ, কখনও রাজস্থান মাঠ। পথচলতি কেউ কেউ বলছেন, আরে, এটা সুরজিৎ না! কেউ চলন্ত বাস থেকে আচমকা নেমে একবার হাত মেলাতে চাইছেন। কেউ আবার সহানুভূতি দেখিয়ে বরলছেন, আহা কী ফুটবলার ছিল। এখন কিনা খোলা মাঠে খেলতে হচ্ছে। কেউ আবার জ্যাঠামি করে জ্ঞান দিচ্ছেন, ইস্টবেঙ্গল–মোহনবাগানে খেলেছেন। কেন শেষ বয়সে সম্মান নষ্ট করছেন! এসব শুনতে শুনতেই এগিয়ে যেতে হয়েছে মাঠের দিকে। কখনও দু–এক কথায় উত্তর দিয়েছেন। কখনও আলতো হেসে এড়িয়ে গেছেন। আবার কখনও অফিস থেকে সোজা এসেছেন মাঠে। মাঠের ধারে একটু আড়াল খুঁজে পোশাক বদল। নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াও কিন্তু কম চ্যালেঞ্জের ছিল না।
সেই চ্যালেঞ্জেও সসম্মানেই উতরে গিয়েছিলেন সুরজিৎ। গতিতে হয়ত মরচে পড়েছে, সেই দাপট হয়ত নেই। কিন্তু যা আছে, তাই বা কম কী! সেই ঠিকানা লেখা পাস, সেই দুরন্ত ড্রিবলিং, মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠা। দিকে দিকে ‘সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’। ছোট ক্লাবের খেলা দেখতেও কিনা হাজার কুড়ি–পঁচিশ দর্শক! এতদিন খেলেছেন বড় ক্লাবের জার্সিতে। সেইসব দলের লক্ষ লক্ষ সমর্থক। কিন্তু জর্জের খেলা দেখতে যাঁরা আসছেন, তাঁরা কস্মিনকালেও জর্জের সমর্থক নন। তাঁরা আসছেন সেই শিল্পী সুরজিতের টানেই। একসময় চুনী গোস্বামীর অফিস লিগের খেলা দেখতেও ভীড় হত। কিন্তু ছোট ক্লাবের জার্সিতে সুরজিৎকে ঘিরে যে প্লাবন ছিল, তা আগে বা পরে আর কাউকে ঘিরে দেখা যায়নি।
এখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর পরই চাকরিসূত্রে গেলেন শিলিগুড়িতে। প্রাক্তন সেলিব্রিটি ফুটবলার–এই তকমাটাই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু সেখানে গিয়েও খেলার মাঠ থেকে দূরে রইলেন না। নেমে পড়লেন বিবেকানন্দ ক্লাবের হয়ে, শিলিগুড়ি লিগে। সেই খেলা দেখতেও কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে কাতারে কাতারে মানুষ।
দেশের প্রথমসারির এক ফুটবলার। তিনি কিনা খেলা ছাড়ার এত বছর পরে নেমে পড়ছেন ছোট ক্লাবের জার্সিতে! এ দেশের ফুটবলে আর কজন এমনটা করে দেখিয়েছেন! আমি সুরজিৎ সেনগুপ্ত, আমি কেন এমন অখ্যাত ক্লাবে খেলব। এমন ভাবাটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি চেনা ছকের বাইরে। তাই এই ভাবনাকে ড্রিবল করে বেরিয়ে গেছেন। বুকের পাটা লাগে। হ্যাঁ, শিল্পীদেরও বুকের পাটা থাকে।