Categories খেলা

একটু পা চালিয়ে ভাই

সরোজ চক্রবর্তী

বছর তিন আগের কথা। তখনও পৃথিবী অনেকটাই সচল। তখনও করোনা নামক শব্দটা শুনিনি। ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখতে পাড়ি দিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। যতটা না কভার করতে, তার থেকে বেশি বোধ হয় বেড়াতে। চিরদিন ফুটবল সাংবাদিকতা করেছি। তাই ক্রিকেটের মহাযজ্ঞে গিয়েও বারবার মন পড়েছিল সেই ফুটবলের দিকেই। আমাকে লর্ডস যেমন টানছে, তেমনই টানছে ম্যাঞ্চেস্টার। মনে হল, সাহেবদের দেশে এসে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বা ম্যাঞ্চেস্টার সিটির মাঠ দেখব না?‌ তাই একদিন সুযোগ হতেই চলে গেলাম ম্যান ইউ–‌র মাঠে।

একটা অদ্ভুত শিহরণ যেন তাড়া করছে। এখানেই কোচিং করে গেছেন কিংবদন্তি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন!‌ এখানেই খেলে গেছেন বিশ্বের দিকপাল ফুটবলাররা!‌ কখনও পৌঁছে যাচ্ছি মাঠে। কখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি সেই লাল চেয়ারে ঢেকে থাকা গ্যালারিতে। কখনও ঢুকে পড়ছি সাজঘরে। আর সেই সুদৃশ্য মিউজিয়াম। থরে থরে সাজানো বিভিন্ন স্মারক। বিভিন্ন সময়ে ম্যাঞ্চেস্টার যে সব ট্রফি জিতেছে, সাল ধরে ধরে সেগুলো রাখা আছে। দিকপাল খেলোয়াড়দের জার্সি, বুটের পাশাপাশি তাঁদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রি। মনে হচ্ছিল যেন চলমান এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ম্যান সিটির সঙ্গে সেই রোমাঞ্চ হয়ত ছিল না। তাছাড়া, সেটা অনেকটা ফাঁকা জায়গায়। এতখানি জাঁকজমক সেখানে নেই।

ঢেকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার হয়েছে সেই দশা। ক্রিকেট বিশ্বকাপে গিয়ে মন পড়েছিল ফুটবল স্টেডিয়ামের দিকে। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে!‌ চিরকাল মোহনবাগান–‌ইস্টবেঙ্গল দেখে বড় হলাম। ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়েও তাই মন পড়েছিল দুই প্রধানে। বারবার মনে হচ্ছিল, আমাদের ক্লাবগুলোর সমর্থক তো কম নয়। আমাদের ইতিহাসও তো কম সমৃদ্ধ নয়। তাহলে, ম্যাঞ্চেস্টার যা পেরেছে, মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল কেন তা পারে না?‌ কলকাতায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের কি আমরা মোহনবাগান–‌ইস্টবেঙ্গলে টেনে আনতে পারি না?‌ এই সব ক্লাবের সাজঘর, মিউজিয়াম, গ্যালারিকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় না?‌ সাধারণ মানুষের জন্য তা খুলে দেওয়া যায় না?‌

ওল্ড ট্র‌্যাফোর্ডে গিয়ে বুঝলাম, আমি একা নই। আমার মতো অনেকেই ক্রিকেট দেখতে এসে ভীড় করেছেন এই ম্যাঞ্চেস্টারের মাঠে। সেই তালিকায় সাংবাদিক যেমন আছেন, তেমনই আছেন সাধারণ দর্শকও। এর বাইরেও রোজ একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ হাজির হয়ে যান এই ক্লাবে। কেউ এসেছেন সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে। আবার অনেকেই এসেছেন বাসে চড়ে। একসঙ্গে এতজন জড়ো হলেন কীভাবে?‌ খোঁজ নিয়ে জানলাম, এঁরা সাধারণ পর্যটক। এই দেশে ঘুরতে এসেছেন। এটা–‌সেটা দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে ট্যুর অপারেটররা তাঁদের এইসব ক্লাবগুলোতেও ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ট্যুর অপারেটররা তো কলকাতায় আসা পর্যটকদের খেলার মাঠে নিয়ে আসেন না। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের সামনে যদি এরকম বাস এসে দাঁড়াত!‌ মনে মনে সেই দৃশ্য কল্পনা করে নিলাম। একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ যেন তাড়া করছিল।

‌ইংল্যান্ড সফর সেরে ফিরে আসাও তিন বছর হয়ে গেল। পৃথিবীর ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেল। মাঠ থেকে খেলাধূলা অনেকটা হারিয়েই গেল। কিন্তু প্রশ্নটা মনের মধ্যে থেকেই গেল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই দুই ক্লাবের কর্তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুই ক্লাবের কর্তাদেরই বলেছি নিজের আক্ষেপের কথা। তাঁরাও অনেকটা একমত হয়েছেন। নানা পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছেন। নানা সমস্যার কথাও শুনেছি। কখনও সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার কখনও মনে হয়েছে, দেরিতে হলেও শুরু তো হয়েছে। আজ না হোক, বছর দশেক পরে হয়ত অন্য কোনও ছবি দেখা যাবে।

কলকাতার দুই প্রধানই শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। দুই প্রধানেরই সদস্য সমর্থকরা দেশের নানা প্রান্তে, এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে আছেন। সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল প্রযুক্তিতেও অনেকটা এগিয়ে গেছে। দুই ক্লাবই আইএসএলে খেলছে। কিন্তু আধুনিকতার যদি তুলনা টানতে হয়, তাহলে ইস্টবেঙ্গল অনেকটাই এগিয়ে। মোহনবাগানের ঐতিহ্য অনেক পুরনো। একদিকে বনেদি পরিবারের লোকেরা যখন মোহনবাগানের হয়ে গলা ফাটাতেন, তখন ইস্টবেঙ্গল ছিল ছিন্নমূল, উদ্বাস্তুদের আশ্রয়। শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে অনেকটাই তফাত ছিল। গোষ্ঠ পালকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে এসে শৈলেন মান্না, উমাপতি কুমারদের মতো দিকপালদের দেখেছি। তাঁদের সান্নিধ্যে এসেছি। দেখেছি ধীরেন দের মতো দাপুটে কর্তাকেও। কিন্তু মোহনবাগানে লন ছাড়া দেখার তেমন কিছু ছিল না। বিকেল দিকে সেখানে আড্ডা দিতেন দিকপালরা। সান্ধ্য আড্ডার জন্য সত্যিই দারুণ। কিন্তু এর বাইরে এমন কিছু ছিল না যা দেখে বাইরে থেকে আসা কোনও সমর্থক দারুণ রোমাঞ্চিত হতে পারেন।

ইস্টবেঙ্গল সেখানে অনেকটাই এগিয়ে। জ্যোতিষ গুহ বা নৃপেন দাসরা দায়িত্বে থাকাকালীন অনেক সাফল্য, অনেক ট্রফি এসেছে। দারুণ দল গঠন হয়েছে। অন্য ক্লাব থেকে সেরা খেলোয়াড়দের আনা হয়েছে। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই তখন ক্লাব ছিল একেবারেই ফুটবল কেন্দ্রিক। ফুটবলের বাইরে অন্য কোনওভাবে ক্লাবকে আধুনিক করে তোলার চেষ্টা তেমনভাবে দেখা যায়নি। এই চেষ্টা দেখা গেল অনেকটা পল্টু দাসের সময় থেকে। নতুন শতাব্দীর গোড়া থেকেই তিনি ক্লাবের পরিবেশে অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেন। সেই কাজই এখন আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বর্তমান কর্তারা। আশিয়ান জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, সেই স্বপ্নটাকে তাড়া করেছিলেন। সাত তারা হোটেলে দীর্ঘ একমাসের বেশি সময় ধরে হয়েছিল আবাসিক শিবির। ভারতের ক্লাব ফুটবলে তার আগে এমন নজির ছিল কিনা জানি না। এখন অনেক দলকেই দেখি পাঁচতারা বা সাততারা হোটেলে থাকছে। কিন্তু এই ব্যাপারে দু’‌দশক আগে পথ দেখিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তখনি ক্লাবে জাকুজি বসেছিল। হয়েছিল অত্যাধুনিক জিমনাশিয়াম ও ড্রেসিংরুম। যত দিন গেছে, কর্তারা সেগুলি আধুনিক থেকে আধুনিকতর করে তুলেছেন। ক্যাফেটোরিয়া, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম মুকুটে যুক্ত হয়েছে একের পর এক পালক। ক্লাবের লনকেও আগের থেকে অনেক সুদৃশ্য করা হয়েছে। গ্যালারি থেকে প্রেসবক্স, সবেতেই যেন আধুনিকতার ছাপ।

ইংল্যান্ডের ক্লাব আর আমাদের ক্লাবের গঠনগত অনেক ফারাকও আছে। ওখানে যা সহজে করা যায়, এখানে তা করা বেশ কঠিন। প্রথমত, মাঠ নিজেদের নয়। পদে পদে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। বড়সড় সংস্কার তো ছেড়েই দিন, একটা জলের কল লাগাতে গেলেও সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হতে হয়। এতে অনেকটা সময় যেমন চলে যায়। অনেক সময় অনেককিছু বোঝানোও যায় না। ফলে, বাগড়া আসে। ইচ্ছে থাকলেও এমন কত পরিকল্পনা মুলতুবি রাখতে হয়েছে। বা, যেটা হয়ত দশ বছর আগে করা যেত, সেটা দশ বছর পরে হয়েছে। এতে হতোদ্যম হয়ে পড়াই হয়ত স্বাভাবিক। তবু লাল–‌হলুদ কর্তারা লেগে থাকেন। সেই কারণেই কর্তাদের কিছু বাড়তি কৃতিত্ব দিতেই হয়। ক্লাবের সভাপতি ডা প্রণব দাশগুপ্ত একজন ব্যস্ত চিকিৎসক। সচিব কল্যাণ মজুমদার ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্রাক্তন কর্তা, সেইসঙ্গে সাহিত্যিক। দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। ব্যস্ততার মাঝেও যথাসম্ভব সময় দেন। আর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল কান্ডারি দেবব্রত সরকার (‌যিনি ময়দানে নীতু নামেই পরিচিত)‌। দীর্ঘদিন ধরে মাঠ করছেন। উঠে এসেছেন পল্টু দাসের হাত ধরে। পল্টু দাস কীভাবে দল তৈরি করতেন, কীভাবে ক্লাব চালাতেন, খুব কাছ থেকে দেখার ও শেখার সুযোগ হয়েছে। শিখতে শিখতে এই জায়গায় এসেছেন। সেইসঙ্গে নতুন একটা প্রজন্মকেও ক্লাব প্রশাসনের কাজে তুলে আনার চেষ্টা করছেন।

আরও একটা ব্যাপারে ইস্টবেঙ্গল অনেকটা এগিয়ে। তা হল প্রাক্তনদের সম্মান দেওয়ায়। মোহনবাগানেও নানা সময়ে প্রাক্তনদের কাজে লাগানো হয়েছে। কখনও তাঁদের কর্মসমিতিতে আনা হয়েছে। কখনও বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাক্তনরা অনেকবেশি একাত্মতা অনুভব করেন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। সারা বছর নানা অনুষ্ঠান তো আছেই। সেইসঙ্গে নিছক আড্ডা মারতেও প্রাক্তনরা চলে আসেন ক্লাব তাঁবুতে। বিকেল গড়িয়ে যায় সন্ধের দিকে। সন্ধে গড়িয়ে যায় রাতের দিকে। এভাবেই প্রাক্তনদের নানা সুখ দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে যান কর্তা ও সমর্থকরাও। প্রয়াত স্বপন বলও ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। সব প্রাক্তনকে চিনতেন। যোগাযোগ রাখতেন। ব্যক্তিগত সুবিধা–‌অসুবিধাতেও পাশে দাঁড়াতেন। স্বপন বল চলে যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব প্রায় একার কাঁধে তুলে নিয়েছেন দেবব্রত (‌নীতু)‌। প্রাক্তনরাও কোনও দ্বিধা ছাড়াই তাঁকে সব কথা খুলে বলতে পারেন। স্পন্সরের সঙ্গে চুক্তিই হোক বা টেকনিক্যাল কোনও ব্যাপারেই হোক, প্রাক্তনদের ডাকা, তাঁদের মতামত নেওয়ার রেওয়াজটা দীর্ঘদিনের।

গত কয়েক বছরে ময়দানের চরিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। আগে বলা হত স্পনসর। নাম বদলে এখন হয়েছে ইনভেস্টর। অর্থাৎ, তাঁদের হাতেই চলে যাচ্ছে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ। দলগঠনও কার্যত তাঁদের হাতেই। অথচ, পান থেকে চুন খসলেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় কর্তাদেরই। মিডিয়ার সমালোচনা তো আছেই। এখন নতুন যোগ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফ্যানেদের নিত্যনতুন গ্রুপ। এসব ঝড়ঝাপটা সামাল দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। বাইরে থেকে অনেক সমালোচনাই করা যায়। কিন্তু ভেতর থেকে যাঁরা কাজটা করেন, তাঁরাই জানেন কাজটা কতটা কঠিন। একদিকে যখন ইনভেস্টরদের হাতে চলে যাচ্ছে অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ, সেখানে ক্লাবকে নিত্যনতুন নানা উপায়ে আকর্ষণীয় করাটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জের। একদিকে ইনভেস্টরদের নানা দাবিদাওয়া, অন্যদিকে সাবেকি সমর্থকদের আবেগ। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্যের একটা দড়ি টানাটানি লেগেই থাকে।  আগেকার কর্তাদের এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়নি।

তাই বিদেশে গিয়ে ঝাঁ চকচকে পরিকাঠামো দেখে আক্ষেপ হওয়াটাও স্বাভাবিক। আবার আমার শহরের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, সমস্যাগুলোও তো মিথ্যে নয়। সমস্যা থাকবে। তার মাঝেই এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে। কলকাতার তিন প্রধানের মধ্যেই দেরিতে হলেও সেই তাগিদটা দেখা যাচ্ছে। সেদিন ম্যাঞ্চেস্টারে দাঁড়িয়ে যে আক্ষেপটা হয়েছিল, সেই আক্ষেপ যেন একটু একটু করে মিটছে। কিন্তু এখনও অনেকটা পথ বাকি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো করেই বলতে ইচ্ছে করছে, একটু পা চালিয়ে, ভাই।     ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.