নির্মল দত্ত
ঠিক একবছর আগের কথা। টোকিও অলিম্পিকে তখন তিনি সদ্য রুপো জিতেছেন। ভারতের সেটাই প্রথম পদক। প্রথম পদক সব সময়ই বাড়তি একটা উন্মাদনা এনে দেয়। স্বভাবতই তাঁকে ঘিরে উত্তাল সারা দেশ। মণিপুরের সেই মেয়ের দিকে ধেয়ে এল কত প্রশ্ন। কত না বলা কথা থেকে গিয়েছিল মীরাবাই চানুর। কখনও উঠে আসছিল বাবা–মায়ের কথা। কখনও ছেলেবেলার কোচের কথা। কখনও কঠোর পরিশ্রমের কথা। এমন সময় এল একেবারে অন্যরকম একটা প্রশ্ন। এখন নিজের জন্য কী চাইতে ইচ্ছে করছে?
এমন আনন্দের মুহূর্তে তাঁর তো কত কিছুই চাওয়ার ছিল। চাইতে পারতেন আর্থিক নিরাপত্তা। চাইতে পারতেন রাষ্ট্রীয় খেতাব। চাকরি, প্রোমোশন, জমি কতকিছুই চাওয়ার ছিল। কিন্তু অলিম্পিকে পদকজয়ী বলে বসলেন, ‘কতদিন আইসক্রিম খাইনি। আজ খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।’ মীরাবাই চানু নিশ্চিতভাবেই মঙ্গলকাব্য পড়েননি। নিশ্চিতভাবে ঈশ্বরী পাটনির নাম শোনেননি। সেই ‘দুধে–ভাতে’র গল্পও শোনেননি। কিন্তু ইশ্বরী পাটনি আর মীরাবাই চানু কোথাও একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক এক বছর পর। টোকিওর বদলে এবার বার্মিংহাম। অলিম্পিকের পর এবার কমনওয়েলথ গেমস। কমনওয়েলথে সোনা অবশ্য চানুর জীবনে নতুন নয়। চার বছর আগে, গোল্ড কোস্টেও সোনা জিতেছিলেন ভারোত্তোলনে। কিন্তু তখন সোনা জয়টা সেভাবে সাড়া ফেলেনি। অনেক পদকজয়ীর ভিড়ে তিনি ছিলেন নিছক একটা নাম। কিন্তু টোকিও অলিম্পিকের পর থেকে ছবিটাই যেন বদলে গেছে। এখন চানু মানেই বিরাট এক প্রত্যাশা। বিরাট কোনও অঘটন না ঘটলে বার্মিংহামে তিনি যে সোনা জিতছেন, তা একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। অঙ্কটা ছিল পরিষ্কার। ভারোত্তোলনে যাঁরা মীরাবাইয়ের মূল প্রতিপক্ষ, তাঁদের অনেকেই কমনওয়েলথে নেই। কারণ, সেইসব দেশ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ নয়।
তাই পদক আসছে, মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। উৎসবের জন্য একরকম তৈরিই ছিল গোটা গ্রাম। ৪৯ কেজি বিভাগে স্ন্যাচে ৮৮ কেজি, ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১১৩ কেজি। মোট ২০১ কেজি। সোনার সঙ্গে বাড়তি পাওনা কমনওয়েলথ রেকর্ড। সহজ–সরল পাহাড়ি মানুষদের এত রেকর্ড বা পরিসংখ্যান বুঝতে বয়েই গেছে। তাঁরা বোঝেন, ঘরের মেয়েটা সোনা পেয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওনা আর কী হতে পারে!
পাহাড়ের জীবন বড় অদ্ভুত। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। রাত আটটা মানেই চারিদিক শুনশান। একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। আর রাত এগারোটা মানে কার্যত মধ্য রাত। কিন্তু সেই ‘মধ্য রাতে’ই যেন সূর্যোদয় মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে। বেজে উঠল বাজনা। উড়ল জাতীয় পতাকা। শুরু হয়ে গেল থাবাল ছোংবা নাচ। রাতেই যেন উৎসবের আমেজ।
ইম্ফল থেকে অনেকটাই দূরে নংপোক কাকচিং গ্রাম। এখন আর অখ্যাত বলা যাবে না। অলিম্পিকে রুপোজয়ী মীরাবাই চানুর গ্রাম বলে কথা। ফলে, সেই গ্রামও পেয়ে গেছে সেলিব্রিটি তকমা। অলিম্পিকে রুপোর পর এবার এল কমনওয়েলথে সোনা। গোটা রাজ্য যেন তাকিয়ে ছিল এই সোনার মেয়ের দিকেই। মণিপুর বলতেই ভেসে ওঠে বক্সিংয়ের কিংবদন্তি মেরি কমের কথা। ছবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক পদকজয়ী মেরি মেয়েদের বক্সিংয়ে এনেছেন অন্য এক মাত্রা। সেই রাজ্যও যেন নতুন করে পরিচিতি পাচ্ছে ভারোত্তোলনের নতুন রানীর জন্য।
উঠে আসছে চানুর একের পর এক অজানা কথা। যার মধ্যে অন্তত একটা না বললেই নয়। ছোটবেলার কথা। ট্রেনিংয়ের জন্য চানুকে যেতে হত ইম্ফলে। কিন্তু সে তো বাড়ি থেকে অনেকটা দূর। গাড়ি ভাড়া করে তো রোজ যাওয়া সম্ভব নয়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ট্রাক পেরোলেই হাত দেখাতেন। অনেক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে মুখ চেনা হয়ে গেল। অনেক সময় সেই ট্রাক চালকরা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হর্ন বাজাতেন। সেই হর্নের আওয়াজ শুনে চানু বুঝতেন, ট্রাক আসছে। এভাবেই ট্রাকে চেপে দিনের পর দিন গেছেন ইম্ফলে।
অনেক বছর পর। সেই চানু পদক জিতলেন অলিম্পিকে। রীতিমতো সেলিব্রিটি। গ্রামে ফিরেই অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হল চানুর। খুঁজে বের করলেন সেইসব ট্রাকের ড্রাইভার আর হেল্পারদের। যাঁরা দিনের পর দিন চানুকে পৌঁছে দিয়েছেন ইম্ফলে। নিজের বাড়িতে সবাইকে ডাকলেন। একদিন হইহই করে তাঁদের সঙ্গেই কাটালেন। বিভিন্ন জায়গায় পুরস্কার, সংবর্ধনায় যে টাকা উঠে এসেছে, সেখান থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা তুলে দিলেন সেই ট্রাক ড্রাইভার আর হেল্পারদের হাতে। মোদ্দা কথা, সেই শুরুর দিনগুলোয় যাঁরা তাঁকে একটু একটু করে এগিয়ে দিয়েছিলেন লক্ষ্যের দিকে, তাঁদের কাউকেই ভোলেননি সেলিব্রিটি হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি।
অলিম্পিক পদক নিছক একটি পদক নয়। জন্ম দিয়ে যায় কত অজানা উপাখ্যানের।