ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান ক্রীড়া সাংবাদিকরা

অজয় নন্দী

হঠাৎ কয়েকটা ফেসবুক পোস্টে জানতে পারলাম, আজ নাকি ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। বিভিন্ন ক্রীড়া সাংবাদিকেরা দিনটি নানাভাবে স্মরণ করেছেন। নানারকম ছবি পোস্ট করেছেন। নিজেদের কীর্তির বীরগাথা রচনা করেছেন।

ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল–‌একাল নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। যাঁরা সেকালের সাংবাদিক, তাঁরা একালকে কী চোখে দেখেন, যাঁরা একালের সাংবাদিক, তাঁরা সেকালকেই বা কী চোখে দেখেন। এই নিয়ে নানা সভায় নানা গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়েছে। আর এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে তো সেই আলোচনা ঘরে ঘরে পৌঁছেও যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত কিছু শোনার বা জানার আগ্রহ আছে কি?‌

কয়েকটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রতিবার বইমেলায় খেলা সংক্রান্ত অন্তত কুড়ি খানা বই বেরোয়। এবারে সংখ্যাটা আরও বেশি। কজন ক্রীড়া সাংবাদিক সেইসব বই কেনেন?‌ কজন পড়েন?‌ গত পাঁচ বছরে পাঁচটা বই পড়েছেন, এমন ক্রীড়া সাংবাদিক সত্যিই দুর্লভ। হাতে গোনা।

সার্বিকভাবেই পড়ার অভ্যেসটা কমে যাচ্ছে। এতে প্রায় সবাই কম–‌বেশি আক্রান্ত। একজন আইটি সেক্টরের ছেলে বা একজন ম্যানেজমেন্ট পাস করা ছেলে পড়ল কিনা, তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কিন্তু সাংবাদিকদের বড় একটা অংশ মনে করতে শুরু করেছেন, পড়াশোনার কোনও দরকার নেই। বই তো ছেড়ে দিন। এক পাতা কাগজ পড়ার লোকও বড্ড কমে আসছে।

অনেকে বলেন, রোজ এত কিছু পড়া সম্ভব নয়। কোনও কোনওদিন ব্যস্ততা থাকতেই পারে। হয়ত সেদিন পড়া হল না। কিন্তু মাসে একদিনও কি পড়া হয়?‌ জিজ্ঞেস করুন, খবরের কাগজে শেষ কবে দু’‌পাতা পড়েছেন?‌ কেউই স্বীকার করবেন না। গায়ের জোরে, গলার জোরে বলবেন, পড়ি তো। কিন্তু একটু কথা বললেই বোঝা যায়, বহুদিন খবরের কাগজের একটি পুরো পাতা পড়েননি। শুধু নামগুলো উল্টে পাল্টে দেখেছেন। কে কেন বাইলাইন পেল, কে কোন ট্যুরে যাচ্ছে, তা নিয়ে গুলতানি করেছেন। কিন্তু লেখাগুলো আর পড়া হয়ে ওঠেনি।

কয়েকটা ছো্ট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রতি রবিবার দুরন্ত একটা কলাম লিখছেন গৌতম ভট্টাচার্য। সংবাদ প্রতিদিনের ‘‌রোববার’‌ ক্রোড়পত্রে। একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের জীবনের ঘাত–‌প্রতিঘাত নিয়ে চমৎকার একটা লেখা। যে কোনও ক্রীড়া সাংবাদিকের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। কজন পড়েছেন?‌ একটা কিস্তিও পড়েননি, এমন ক্রীড়া সাংবাদিকের পাল্লাই ভারী। দু একটা একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়া যাক। মোহনবাগানের নানা অজানা গল্প নিয়ে চমৎকার একটা বই লিখেছেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও রূপক বসু। কজন সতীর্থ সেই বই পড়েছেন?‌ এক মহিলা ক্রিকেটারের জীবনের চড়াই–‌উতরাই নিয়ে চমৎকার একটি উপন্যাস লিখেছেন সাংবাদিক অভিষেক সেনগুপ্ত। কজন পড়েছেন?‌ অথচ, ফেসবুকের দৌলতে জানেন না, এমনটাও বলা যাবে না। বেশ জানেন। কিন্তু কেনার বা পড়ার তাগিদ অনুভব করেননি। সৌরভ গাঙ্গুলির জন্মদিনে চমৎকার একটি ক্রোড়পত্র বের করল সংবাদ প্রতিদিন। পুরোটা পড়া ছেড়ে দিন, দশ পাতা পড়েছেন, এমন ক্রীড়া সাংবাদিক কলকাতা ময়দানে দশজন খুঁজে পাওয়া যাবে!‌

আসলে, এখানেও পড়ার অভ্যেসটাই চলে গেছে। সারাদিন মোবাইলে মগ্ন থেকে থেকে ভেবে ফেলেছেন, তাঁরা বোধ হয় দারুণ আপডেটেড। আসলে, ঠিক উল্টোটা। তাই চারদিন আগে বেরিয়ে যাওয়া কপিও দিব্যি ঢাউস বাইলাইন কপি হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট টুকরোর মধ্যে লিড হওয়ার উপাদান আছে। কিন্তু দেখার চোখটা তো চাই। সবথেকে বড় কথা, ওই ছোট্ট টুকরোটা পড়লে তবে তো ফলোআপের ভাবনাটা আসবে। এভাবেই কত দারুণ স্টোরি হতে হতেও হয় না। স্রেফ না পড়ার কারণে।

আগে যদিও বা মাঠে যাওয়ার রেওয়াজটা ছিল। এর তার সঙ্গে দেখা হত। তাতেও দু–‌চারটে খবরের হদিশ মিলত। এই করোনা এসে সবাইকে যেন আস্ত কুঁড়ে বানিয়ে দিয়েছে। মাসে দু’‌দিন মাঠে যান, এমন রিপোর্টার এখন কজন?‌ ইডেনে বা যুবভারতীতে ম্যাচ থাকলে একটা উৎসাহ থাকে। তার বাইরে প্র‌্যাকটিস দেখা বা নিছক খবরের খোঁজে ক্লাবে যাওয়া প্রায় উঠেই গেছে। ফোনে খোঁজ নিতেও বড্ড অনীহা। ফেসবুকে কোনও একটা পোস্ট চোখে পড়ল। তা থেকেই যেটুকু খবর হল। মাঠের সাংবাদিকতাও বড় বেশি ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়েছে।

ডেস্কের কপিতেও বড্ড বেশি কেরানির গন্ধ। এজেন্সি বা পোর্টাল যে অ্যাঙ্গেলে কপি করছে, হেডিং করছে, কাগজেও ঠিক তাই। একটু অন্যভাবে ভাবার চেষ্টা, একটু অন্যভাবে লেখার চেষ্টা চোখেই পড়ছে না। মন কেড়ে নেওয়া দু একটা হেডিং যদিওবা থাকে, খুব কম ডেস্কের কপিতে প্রাণ খুঁজে পাই। নিতান্ত দায়সারা গোছের দু’‌শো বা আড়াইশো লিখে দেওয়া। জানা আছে, বাইলাইন পাওয়া যাবে না। কে আর মাথা খাটায়?‌ কে আর ভেবেচিন্তে ভাল লেখা দাঁড় করায়?‌

কম বেশি সবাই যেন রিফ্লেক্টেড গ্লোরিতে আচ্ছন্ন। তারকার পাশে দাঁড়ানো। ছবি তোলা। আর ব্রেকিং নিউজের মতো সেটা ফেবুতে সাঁটিয়ে দেওয়া। ইডেনের প্রেস বক্সে গেলে তো কথাই নেই। ‘‌অনেকদিন পর ইডেনের প্রেসবক্সে’‌ মার্কা ক্যাপশান দিয়ে ছবি। যেন কত ল্যাপটপে কাজে মগ্ন। অথচ, চোখ সেই ক্যামেরার দিকেই। ইডেন যেতে না পারলে আর সেটা ঢাউস করে প্রচার করতে না পারলে যেন জীবন বৃথা। যুবভারতীর ক্ষেত্রেও একই কথা। এখানে ভেনু বদলে যুবভারতীর প্রেসবক্স। ক্রিকেটারদের গা ঘেঁসে ছবি তোলার সুযোগটা আপাতত কম। তখন ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসে পুরনো ছবি। তারকার পাশে আমি। লাইক, কমেন্ট কিছু পড়ে যায়। এতেই বেজায় তৃপ্তি। অথচ, কে কটা খবর করেছে, হদিশ পাওয়া কঠিন। দু–‌একজন হাতে গোনা রিপোর্টার ছাড়া অধিকাংশের ঝুলিতে বছরে একটাও খবর নেই। মন কেড়ে নেওয়া লেখাও নেই। প্রিভিউ আর প্রেস কনফারেন্সে বাইলাইন।

মোদ্দা কথা, না আছে পরিশ্রম। না আছে পড়াশোনা। না আছে মেধা। না আছে লেখার মুন্সিয়ানা। না আছে সেই পর্যায়ের যোগাযোগ। না আছে ন্যূনতম সংযম।

তাহলে, রইলটা কী?‌

ক্রীড়া সাংবাদিক দিবসে কি আয়নার সামনে দাঁড়াবেন এই প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিকরা?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.