দুষ্টু ছেলে হয়েই থেকে গেলেন শ্রীশান্ত

সরল বিশ্বাস

বছরটা ২০১১। দিনটা ২ এপ্রিল। দিনটা না বলে, বলা ভাল রাতটা। স্থান:‌ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, মুম্বই। টাইম মেশিনে চড়ে এগারো বছর পিছিয়ে চলুন। আর কোনও ক্লু দেওয়ার আছে?‌

হ্যাঁ, সেই বিশ্বজয়ের রাত। ১৯৮৩–‌র পর আবার ২০১১। ২৮ বছরের ব্যবধান পেরিয়ে ধরা দিল বিশ্বকাপ। সেবার বিশ্বজয়ের মঞ্চ ছিল লর্ডস। আর এবার ওয়াংখেড়ে।

শচীন তেন্ডুলকারের ক্রিকেটজীবনে প্রাপ্তির কোনও অভাব ছিল না। ছিল না শুধু সেই বিশ্বকাপ। ২ এপ্রিলের রাত যেন সেই স্বপ্নপূরণ করে দিল। আরব সাগরের তীরের সেই ভিকট্রি ল্যাপটা একবার মনে করুন। কার কার মুখগুলো মনে পড়ছে?‌ সেই তালিকায় যেমন হরভজন সিং, ইউসুফ পাঠান, বিরাট কোহলিরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন শান্তাকুমারণ শ্রীশান্তও।

ঠিক তার চার বছর আগে। এবার টি২০ বিশ্বকাপ। সেটা অবশ্য হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। জোহানেসবার্গে  ফাইনালে সামনে পাকিস্তান। সেই চরম মুহূর্তটা মনে করুন। টানটান উত্তেজনা। মিসবা উল হকের শট উড়ে গেল ফাইন লেগে। চরম উৎকণ্ঠায় তামাম ভারতবর্ষ। ঠিক তখনই দেখা গেল, বলটি তালুবন্দি করলেন শ্রীশান্ত। সেই বিশ্বয়ের ওপর যদি দশ সেকেন্ডের ভিডিও বানানো হয়, সেই ভিডিওতেও অনিবার্য তাঁর উপস্থিতি। কারণ, ওই মোক্ষম মুহূর্তটা বাদ দিলে ওই বিশ্বজয়ের কথা ভাবাই যায় না।

দুবারের বিশ্বজয়ী সৈনিক। অথচ, তারপরই হারিয়ে গেলেন ক্রিকেটের আঙিনা থেকে। অবশেষে অবসর নিলেন। কিন্তু সেভাবে চর্চাই হল না শান্তাকুমারণ শ্রীশান্তকে ঘিরে। অথচ, কেরলের এই জোরে বোলার এতখানি উপেক্ষারও পাত্র ছিলেন না। টেস্ট হোক কি ওয়ানডে, যতদিন খেলেছেন বেশ দাপটের সঙ্গেই খেলেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের হয়ে খেলেছেন ২৭ টেস্ট, ৫৩ একদিনের ম্যাচ। টেস্টে উইকেট সংখ্যা ৮৭, একদিনের ক্রিকেটে ৭৫। দুই ঘরানা মিলিয়ে উইকেট ১৬২। এরই মাঝে দুই ঘরানায় দুবার বিশ্বকাপ জয়। আইপিএলেও তিনটি ফ্র‌্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলেছেন বেশ দাপটের সঙ্গেই।

কিন্তু তারপরেও হারিয়ে গেলেন কেন?‌ আসলে, শ্রীশান্ত আর বিতর্ক যেন হেঁটেছে হাত ধরাধরি করে। কেরল থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে নিজের জায়গা করে নেওয়া খুব সহজ ছিল না। যে সময়টায় খেলেছেন, ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসছেন জোরে বোলাররা। তাঁদের মাঝে জায়গা করে নেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। প্রতিভার জোরেই সেই জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কখনও বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, কখনও উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। ফলে, বোর্ডের কাছে বারবার সতর্কিত হতে হয়েছে। এমনকি নিজের রাজ্য কেরলও তাঁকে বারবার সতর্ক করেছে। নিজেকে শুধরে না নিলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন কড়া বার্তাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি শোধরানোর বান্দা নন। নিজের মতো করেই চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু ২০১৩ তে যা হল, তারপর সব সতর্কতার বাইরে চলে গেলেন। আইপিএলে স্পট ফিক্সিং কান্ডে জড়িয়ে গেলেন। তদন্ত কমিটির রায়ে দোষী প্রমাণিত হলেন। সারা জীবনের জন্য নির্বাসিত করা হল এই জোরে বোলারকে। এরই ফাঁকে কখনও সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন। কখনও নাচের রিয়েলিটি শো–‌তে গেছেন। কখনও টিভি সিরিয়ালে মুখ দেখিয়েছেন। আবার কখনও রাজনীতির ময়দানে এসে ভোটেও দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

এসবের পাশেও ক্রিকেটে ফিরে আসার সুপ্ত একটা ইচ্ছে ছিল। তাই পাশাপাশি অনুশীলনও চালিয়ে গেছেন। বোর্ডের দরজার বারবার কড়া নেড়েছেন নিজের শাস্তি লাঘব করার জন্য। বোর্ডও কিছুটা সহানুভূতি দেখিয়েছে। আজীবন নির্বাসনকে কমিয়ে সাত বছরে আনা হয়েছে। সেই হিসেবে ২০২০–‌র ডিসেম্বরেই তাঁর নির্বাসন উঠে যায়। কিন্তু তখন করোনা আবহ। ফলে, ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সুযোগটাও ছিল না। অবশেষে বিজয় হাজারে ট্রফিতে সুযোগ এল। কিন্তু সে আর কটাই বা ম্যাচ!‌

ভেবেছিলেন, আইপিএলে একবার কামব্যাক করবেন। নিলামে নিজের বেস প্রাইস রেখেছিলেন ৫০ লাখ। কিন্তু নিলামের দিন তাঁকে কোনও দলই নিল না। দ্বিতীয় দিনের নিলামে অনেকে দল পেয়ে গেলেও তিনি সেই ব্রাত্যই রয়ে গেলেন। আসলে, ৩৯ বছরের শ্রীশান্তকে নেওয়ার ঝুঁকি কোনও ফ্র‌্যাঞ্চাইজিই নিতে চায়নি। শ্রীশান্তকে নেওয়া মানে তো শুধু একজন ৩৯ বছরের ক্রিকেটারকে নেওয়া নয়। সেইসঙ্গে আরও নিত্যনতুন বিতর্ককেও আমন্ত্রণ জানানো। শান্তির সংসারে কে আর ঝামেলা বাড়াতে চায়!‌

সুযোগ ছিল রনজি ট্রফিতে নিজেকে আরও একবার চিনিয়ে দেওয়ার। কেরল দলে সুযোগও পেয়েছিলেন। একটা উইকেট নিয়ে উইকেটের ওপর সটান শুয়ে পড়লেন। কিছুটা আবেগ, কিছুটা নাটকীয়তা। মোদ্দা কথা, শো ম্যানশিপকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। চোটের জন্য পরের ম্যাচে আর খেলাই হল না। এরই মধ্যে রনজি থেকে কেরলের বিদায়ও ঘটে গেল।

দেওয়াল লিখনটা পরিষ্কার। সরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায়ই ছিল না এই জোরে বোলারের। ঠিক সেটাই করলেন। কিন্তু বিদায়বেলায় তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তি যত না উঠে এল, রকমারি বিতর্কের কথা উঠে এল আরও বেশি। ক্রিকেট আঙিনার এই দুষ্টু ছেলে যেন নীরবে হারিয়ে গেলেন। আবার কি ফিরে আসবেন, অন্য কোনও ভূমিকায়?‌ সময়ই বলে দেবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.