প্রশান্ত বসু
অনেকেই অনুযোগ করেন, এই বাংলায় বাংলা ভাষা নাকি দ্বিতীয় ভাষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছি, দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় ভাষা হতে চলেছে। এখন প্রায় সবাই নিজেদের সন্তানদের কনভেন্টে পড়াচ্ছেন। বাংলা মাধ্যমে ভর্তি করলে সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
বাবাদের তাগিদ যত না বেশি, মায়েদের তাগিদ তার থেকে ঢের বেশি। ছেলে বাংলা মাধ্যমে পড়লে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে? অতএব, ছেলেকে ভর্তি করো ইংলিশ মিডিয়ামে। যেন গর্ব করে বলা যায়, আমার ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।
এ আর নতুন কথা কী? এই ছবি তো কুড়ি–তিরিশ বছর আগেও ছিল। নতুন যেটা, সেটা হল, তখন বাংলা অন্তত দ্বিতীয় ভাষার (সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ) জায়গায় ছিল। এখন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাখতেও খুব লজ্জা। তাই এখন অবলীলায় দ্বিতীয় ভাষা হয়ে যাচ্ছে হিন্দি। আর ছাগলের তৃতীয় ছানার মতো ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বেঙ্গলি’। অবাঙালিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাঙালি পরিবারেও এখন এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। যুক্তিটা এরকম, বাংলা শিখে তো কাজ পাওয়া যাবে না। সেই তো বাইরে যেতেই হবে। তাই সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দিই থাকুক। আমাদের চারপাশের চেনা পরিমণ্ডলেই এমন যুক্তি ঘোরাফেরা করছে।
আমাদের অনেকের বাড়িতেই এমন ছবি। আমাদের পরের প্রজন্ম দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি পড়ছে। দোষটা তাদেরও নয়। আমরাই তো চাপিয়ে দিয়েছি। ওই ছোট ছোট ছেলেগুলোকে আমরাই তো বোঝাচ্ছি, বাংলা শেখার দরকার নেই। আমার এক প্রতিবেশী, তাঁর মেয়ে থাকেন বেঙ্গালুরুতে। মেয়েকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। বাংলাকে নিয়ে কটাক্ষেরও শেষ নেই। তিনি হয়তো জানেন না, ওই বেঙ্গালুরুতে প্রায় চোদ্দ লক্ষ মানুষ বাংলায় কথা বলেন। অথচ, মধ্য কলকাতার কোনও জায়গায় যদি সারাদিন কাটান, মনেই হবে না আপনি বাংলায় আছেন। এমনকী বাঙালিরাও বাংলা বলতে চাইছেন না। বাসের ড্রাইভার, কনডাক্টর, অটোচালক হিন্দি বলতেই ব্যাকূল।
গত সপ্তাহে একটা অভিজ্ঞতা হল। অটোর চারজন যাত্রীই বাঙালি (তার মধ্যে এই অধমও একজন)। অটো চালকও বাঙালি। কিন্তু কথাবার্তা চলছে হিন্দিতে। এবং লালমোহনবাবুর মতো হিন্দিতে। একসময় ফেলুদার মতো করেই বললাম, আপনারা হিন্দিটা চালিয়ে যেতে পারেন। বেশ লাগছে। সেদিন শিশুর সারল্যে লালমোহনবাবু বলে উঠেছিলেন, ‘ধূর মশাই। হিন্দি কি কেউ সাধে বলে? আমি গড়পাড়ের লোক।’ কিন্তু অটোয় একজন লালমোহনবাবুকেও পেলাম না।