অজয় নন্দী
একদিকে মোহনবাগান জনতার উল্লাস। এত লড়াইয়ের পর আইএসএলের ট্রফি এল। উল্লাস হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের অবস্থাটা ঠিক কেমন? তারা শেষ করল দশ নম্বরে। এগারো দলের মধ্যে দশ নম্বর। নিশ্চয় খুব গর্বের বিষয় নয়। কিন্তু তারপরেও কি লাল হলুদ কর্তাদের টনক নড়েছে?
কোচ স্টিফেন কনস্টানটাইন শুরুতেই বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, কী হতে চলেছে। তাই শুরুতেই সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যে দল একেবারে লাস্ট পজিশনে থাকে, তাদের কাছে প্রথম ছয়ে থাকা মানেই মিরাক্যাল। তাই প্রথম ছয়ে তিনি আশা করছেন না। একদিক থেকে স্টিফেনের দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু শুরুতেই কোচ যদি প্রকাশ্যে এমনটা বলে বসেন, তাহলে ফুটবলারদের মনোবল ধাক্কা খেতে বাধ্য। আইএসএল শেষ হওয়ার পর যখন ছাঁটাইয়ের বার্তা পেলেন, তখনও স্টিফেন বলে বসলেন, আগেরবার এগারো নম্বরে ছিলাম। এবার দশ নম্বরে। আমরা যথেষ্ট সফল। এরপরেও আমাকে সরানো হল কেন?
এ তো গেল মাঠের কথা। কিন্তু মাঠের বাইরে? কর্তারা বোঝেন শুধু গ্যালারি শো। সারা বছর ধরে সেটাই করে চলেছেন। কোনও কাজ করার থেকেও ঢাক পিটিয়ে তা অন্যদের কাছে জাহির করাটাই যেন বারবার প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। দশ নম্বরে শেষ করার পরেও সেই প্রবণতা বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। নতুন মরশুমের দল গঠন করতে হবে। ভাল কথা। ইমামি কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। আরও ভাল কথা। কিন্তু এটাকেও একটা ইভেন্টে পরিণত করে বসলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। দুনিয়ার লোক জেনে গেল, কবে এই বৈঠক হবে। ঘটা করে বৈঠক হল। বৈঠক শেষে জমিয়ে প্রেস কনফারেন্স হল। দেশ দুনিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হল, দেখো, আমরা বৈঠকে বসেছি।
জানানো হল, পয়লা বৈশাখের আগেই কোচ ঠিক করে ফেলা হবে। পয়লা বৈশাখ আসতে তখনও অন্তত কুড়ি দিন বাকি। তার মানে, আগামী কুড়ি দিন কোচ ঠিক হচ্ছে না। তার মানে, কোচের পরামর্শ অনুযায়ী ফুটবলার বেছে নেওয়ার কাজটাও মুলতুবি থাকছে। আগামী কুড়ি দিন আমরা দলগঠন নিয়ে কার্যত হাত গুটিয়ে বসে থাকব, এটাই যেন ঢাক পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, পরের সপ্তাহে আবার আমরা আলোচনায় বসব। সেই দিনটাও জানিয়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ, পরের সপ্তাহেও আপনারা আসুন। আবার নিশ্চয় ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স হবে। সেই বাইট। সেই টিভিতে কয়েক সেকেন্ডের উপস্থিতি। সেই কাগজে বিবৃতি। এত কিছুর পরেও বিবৃতির রোগটা আর গেল না।
কর্তারা দল গঠন নিয়ে স্পনসরের সঙ্গে আলোচনা করতেই পারেন। কিন্তু সবকিছু এমন ঘটা করে করতে হয়? এতে বাড়তি প্রচার হয়ত পাওয়া যায়। নিজেদের ঢাক পেটানো যায়। কাজের কাজ বিশেষ কিছু হয় না।
কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা ঘটা করে চিঠি লিখেছিলেন স্পন্সর ইমামিকে। কোন কোন ফুটবলারকে এবার ধরে রাখা উচিত, কাকে কোচ করে আনা উচিত, কোন কোন ফুটবলারকে ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেই সংক্রান্ত চিঠি।
ক্লাব কোচের কাছ থেকে তালিকা নিতেই পারে। স্পন্সরকে সেই তালিকা জানাতেই পারে। এর মধ্যে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ছেলেমানুষিটা অন্য জায়গায়। সেই তালিকা স্পন্সরদের কাছে যাওয়ার আগেই ফাঁস হয়ে গেল। শুধু ফাঁস হল বললে কম বলা হয়, বলা ভাল, ফাঁস করে দেওয়া হল। ক্লাবের ফেসবুক পেজে সেই তালিকা আপলোড করে দেওয়া হল।
হায় রে! কাদের হাতে রয়েছে ক্লাব পরিচালনার ভার! এই তালিকা যে বাইরে প্রকাশ করতে নেই, এই বোধটুকুও নেই! প্রথমত, এই তালিকা একান্তই গোপন একটা তালিকা। এটা লিক হবে কেন? যাঁরা এই তালিকা তৈরি করছেন, তাঁদের এটুকু বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না? তাহলে, এমন গুরুদায়িত্বে তাঁদের রাখা হয়েছে কেন?
কর্তাদের অনিচ্ছায় ফাঁস হয়েছে, এমনও নয়। তাহলে ক্লাবের সরকারি ফেসবুক পেজে এল কীভাবে? সেটা তো বাইরের লোক হ্যান্ডল করে না। ক্লাবের বিশ্বস্ত কেউ হ্যান্ডল করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তার মানে, হয় সেই তালিকা ইচ্ছে করেই প্রকাশ করা হয়েছে। নইলে, এই তালিকা প্রকাশ করা যায় না, এই বোধটুকুও নেই।
স্পন্সরের সঙ্গে নানা বিষয়ে ক্লাবের আলোচনা হবে, চিঠিচাপাটি হবে, মাঝে মাঝে মতপার্থক্যও হবে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেইসব চিঠিচাপাটি বারবার মিডিয়ায় চলে আসে কেন? যাঁরা এমন গোপন চিঠি নিজেরা ফাঁস করেন, তাঁদের আদৌ এসব চিঠি লেখার অধিকার আছে? সবকিছুতেই এমন গ্যালারি শো করতে হবে?
হতে পারে, স্পন্সরদের কাছে তাঁরা কী চেয়েছেন, সেটা সমর্থকদের জানিয়ে দিলেন। যেন পরে তাঁদের দোষারোপ না করা হয়। কিন্তু এই চিঠি কি প্রকাশ্যে আনার জিনিস? একটা পাড়ার ক্লাবের কর্তারাও জানেন, কোনটা লোককে জানাতে হয়, কোনটা জানাতে নেই। ভাবতে অবাক লাগছে, শতবর্ষপ্রাচীন ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানটুকু নেই। এঁরা আনবেন পেশাদারিত্ব!
এইসব কর্তারা যদি মাথায় থাকেন, সেই দল দশ নম্বরে থাকলে সেটা সত্যিই বড় সাফল্য।