নতুন স্বপ্নের নাম সাইকা

‌তপোব্রত তালুকদার

সাইকা ইশাক। বাংলার ক্রিকেটে নামটা এখন বেশ পরিচিত। একমাস আগেও এই মেয়েটিকে কজন চিনতেন?‌ বাংলার ক্রিকেট বলতেই আমরা বুঝতাম ঝুলন গোস্বামীকে। একসময় ঝুলনের সঙ্গেই উচ্চারিত হত রুমেলি ধরের নাম। তারও পরে প্রিয়াঙ্কা রায়। কিন্তু একটা সময় তাঁরা কোথায় যে হারিয়ে গেলেন। ঝুলন কিন্তু থেকে গেলেন দুই দশক ধরে।

কয়েকমাস আগেই ভারত জিতল মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীরা তিনবার ফাইনালে উঠলেও ট্রফির স্বাদ পাননি। প্রথমবারেই সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ট্রফি আনলেন স্মৃতি মানধানা, রিচা ঘোষরা। এই দলে ছিলেন তিন বঙ্গললনা। রিচা বা তিতাস সাধু মেয়েদের আইপিএলে ডাকও পেলেন। কিন্তু বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারলেন না। মানে, সেভাবে ছাপ ফেলতে পারলেন না।

ডব্লুপিএলে বাংলার সেরা আবিষ্কার নিঃসন্দেহে সাইকা ইশাক। এই বাঁ হাতি স্পিনার বাংলার বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। চ্যালেঞ্জার ট্রফিতেও খেলেছেন। একটা সময় চোটের কারণে ক্রিকেট থেকে হারিয়েও গিয়েছিলেন। ধরেই নিয়েছিলেন, খেলার মাঠে আর বোধ হয় ফিরে আসা হবে না। কিন্তু সেই সাইকার জন্য এমন চিত্রনাট্য লেখা ছিল, কে জানত!‌

নিলামে প্রথম দফায় তাঁকে কেউ ডাকেনি। দ্বিতীয় দফায় বেসপ্রাইসে নিয়েছিল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। নিলামের টেবিলে ঝুলন গোস্বামী না থাকলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর নামটা কারও মাথাতেও আসত না। প্রথম ম্যাচেই তুলে নিলেন মাত্র ১১ রানে ৪ উইকেট। হরমনপ্রীতের ঝোড়ো শতরানটা না এলে সাইকাই হতেন ম্যাচের সেরা। বলা যায়, অধিনায়কের ব্যাটিং ঝড়ে কিছুটা যেন ম্লান হয়ে গেলেন। পরের ম্যাচগুলিতেও দুরন্ত দাপট বজায় রইল। মাত্র পাঁচ ম্যাচেই হয়ে গিয়েছিল ১২ উইকেট। ধারেপাশেও ছিলেন না অন্যরা। শেষ ল্যাপে কিছুটা যেন পিছিয়ে গেলেন। দৌড় থামল ১৫ উইকেটে। উইকেট সংখ্যার বিচারে তৃতীয়।

সাইকার উঠে আসার ইতিহাসটা খুব মসৃণ ছিল না। পার্ক সার্কাসের ছোট্ট এক ঘিঞ্জি এলাকায় বেড়ে ওঠা। ওই এলাকায় একজন মেয়ে ক্রিকেট খেলছে, এমন দৃশ্য ভাবাটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সাইকা এতটাই বেপরোয়া, কে কী বলল, কে কী ভাবল, পরোয়াই করতেন না। ছেলেদের সঙ্গেই মেতে উঠেছিলেন গলির ক্রিকেটে। তাঁর দুম দাম শটে আশেপাশের কত বাড়ির জানালার কাচ ভেঙেছে, পথচলতি কত মানুষের গায়ে বল পড়েছে, হিসেবে নেই। কেউ হয়ত দু’‌কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন। সাইকাও কম যান না। পাল্টা শুনিয়ে দিয়েছেন, ‘‌দেখ কে চল নেহি সাকতা?‌’‌ বেচারা পথিক!‌ আর কথা না বাড়িতে সুটসুট করে হাঁটা দিয়েছেন।

কিন্তু চোটের পর একটা সময় যখন হারিয়ে যাচ্ছেন, তখন মেয়েদের কোচ মিঠু মুখার্জি তাঁকে পাঠালেন বাংলার আরেক প্রাক্তন স্পিনার শিবসাগর সিংয়ের কাছে। শিবসাগর বুঝেছিলেন, এই মেয়ে ঠিকঠাক তালিম পেলে অনেকদূর যাবে। তাই নিয়ে গেলেন ছেলেদের নেটে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নেটে ছেলেদের দিনের পর দিন বোলিং করে গেছেন এই মেয়েটি। কেউ জানতেও পারেনি। তাঁর স্পিনের কাছে কুপোকাত হয়েছে কত ব্যাটসম্যান। নিঃশব্দেই নিজেকে তৈরি করেছেন।

অবশেষে ডব্লুপিএল যেন লিখে দিল অন্য এক চিত্রনাট্য। কলকাতার দল নাইবা থাকল, কলকাতার মেয়ের নজরকাড়া পারফরমেন্স তো আছে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের জয়ের বড় কাণ্ডারি তো বাংলার সাইকাই। ২৭ বছর বয়সটা একটু বেশি। ফলে, ঝুলনের মতো দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলতে পারবেন, এমন নয়। তবু অন্তত চার–‌পাঁচ বছরও যদি দাপট দেখাতে পারেন, মন্দ কী?‌ ডব্লুপিএলের এই দুরন্ত সাফল্য হয়ত খুলে দিতে পারে জাতীয় দলের দরজা। সেখানে অন্তত কয়েক বছরের জন্যও রিচার পাশাপাশি সাইকাও যদি দাপট দেখিয়ে খেলে যান, বাংলার কাছে সেটাই হবে বড় প্রাপ্তি।

‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.