‌সৌম্য গায়েনের গল্প:‌ বন্ধু

বন্ধু

ডা.‌ সৌম্য গায়েন


‌আজ ঝিঙের খুব মনখারাপ। মাইকে যে গানটা বাজছে সেটা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। ঝিঙে জানে। …‘‌ওগো দুখ জাগানিয়া, তোমায় গান শোনাবো’‌। ঝিঙের মাঝে মাঝে মনে হয়, ভদ্রলোককে একবার পরপারে গিয়ে দেখে আসে। গুরু কী লিখেছে মাইরি। একেবারে খাপে খাপ, পঞ্চুর…..। ইয়ে, মানে …..যাকগে। একটা কথা ঝিঙে ভাবে, শামুক কোনওদিন ঠিকঠাক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেনি।

যদিও শামুকের খুব নাম এপাড়ায়, দুর্দান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। কিন্তু তোমরাই বল, ঠিকঠাক রবীন্দ্রসঙ্গীত জানলে শামুক কি ঝিঙের লুজ হয়ে যাওয়া প্লাগ পয়েন্টটার কথা টের পেত না? বুঝতে কি পারত না, শামুককে দেখলেই ওর দিমাগ কি বাত্তি কেন অচানক ফস্ করে লো ভোল্টেজ হয়ে যায়? এই যে আজ মহাষষ্ঠী! করোনার বাজারেও ঝিঙেরা সরকারের ষাট হাজার আর নিজেদের স্পনসর মিলিয়ে একটা কনসেপ্ট পুজো নামিয়েছে, সেটা কি শুধু ঐতিহ্য রক্ষার জন্য? শামুক কি জানে, পুজো হচ্ছিলই না! ঝিঙে প্রায় নিজের জান বাজি রেখে সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। কার জন্য? ওপাড়ার চম্পাকলির জন্য নিশ্চয়ই নয়! দুর্গাপুজোর সন্ধ্যাগুলোতে শামুকের মুখে যে হাজার ওয়াটের আলোর রোশনাই খেলা করে, তাকে কি গুগল পে তে মাপা যায়! তিন বছর আগে ওই প্লাজমার ঝলকানিই ঝিঙের বুকে ছুরির মতো ঢুকে সোজা ওর হৃদয়টা উপড়ে নিয়ে সেই যে সাঁৎ করে পালাল, আর ফেরার নামগন্ধ নেই।

‌— অ্যাই যে, নির্ঝর! তোমাদের মহাষষ্ঠীর অঞ্জলি কখন শুরু হবে?
‌ঝিঙে তাকিয়ে দেখে, সবিতা কাকিমা।
‌— এই তো কাকিমা! আর আধঘন্টা।
—সত্যি বাবা, তোরা দেখালি! আমি তো ভেবেছিলাম এবার আর পুজো হলই না, যা দিনকাল এল। কি একটা ভাই না বোন, একটা এসেছে! বাপের জন্মে এরম শুনিনি বাপু।
‌ঝিঙে সবে বলতে যাচ্ছিল, বাবার জন্ম আবার কবে দেখলেন কাকিমা!…. কথাটা গলায় এলেও কোঁৎ করে গিলে ফেলল হঠাৎ।
‌শামুক আসছে এদিকে, টার্গেট সোজা ঝিঙে! ঝিঙের মনে হল নীচ থেকে কী যেন একটা টাকের দিকে উঠে আসছে।

‌অম্বরচন্দ্র কলেজের একটা ফ্যাব ডে আজ। ‘‌আলোড়ন’‌ এর দ্বিতীয় দিন। ফেস্ট এর এই দিনে বিভিন্ন প্রদর্শনী হয়। নির্ঝর ফার্স্ট ইয়ারের চিরকালীন ল্যাদ ছেলে। নড়ে খেতে চায় না। ওর উপরেই ছাড়া হয়েছে ক্যাও প্রদর্শনীর ভার। ভীষণ খাটুনি। অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দিয়ে করতে হয়। ধরা যাক একটা পাখির বাসা বানানো হল। কিন্তু ক্যাও তে সেটা দেখতে হতে হবে ঠিক প্রফেসর রায়ের চুলের মতো। দেখলেই যাতে পাবলিকের প্রফেসর রায়ের কথা মনে পড়ে।
‌তো জায়গা হিসেবে নির্ঝর পছন্দ করেছিল হলঘরের কোনটা। গিয়ে দেখে আগেই ওখানে সেকেন্ড ইয়ারের জন, ক্যাংলাদারা সায়েন্স ফিকশন একজিবিশানের জন্য বসে আছে। অথচ ওদের সামনের দিকে থাকার কথা।
‌— এই তোমরা এখান থেকে সরে যাও। এটা তো আমাদের জায়গা। নির্ঝর বলে ওঠে
‌— তুমি কে কাকা? তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দেয় জন।
‌— আমি নির্ঝর। ফার্স্ট ইয়ারের।
‌— অ! তাহলে বেশি বাওয়াল না করে ঝরঝর করে পাতলা হও কুচুমুনু। আমরা এখানে কাজ করছি।
‌আসলে নির্ঝর বুঝতে পারল এই জায়গায় থাকলে ওদের বেশি কিছু করতে হবে না, উপরন্তু মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে ফুঁকেও আসতে পারবে। তার ওপর আছে বার্ডস্ আই ভিউ। হলঘরের এই জায়গাটা একটু উঁচু। এখান থেকে মেয়েদের খুব ভাল ঝাড়ি করা যায়। ইনফ্যাক্ট নির্ঝর নিজেই একটু দেখবে ভেবেছিল ;- শিরিনকে……
— এ্যাই! কি হচ্ছে এখানে?
‌চমকে পেছনে তাকায় নির্ঝর। দেখে ফাইনাল সেমের জিশানদা।
— তোরা সরে যা এখান থেকে। জিশানদা নরম গলায় জনদাকে বলে।
জিশানদা অদ্ভুত ছেলে একটা। কলেজের ফার্স্ট বয়। ফাটাফাটি গান করে। কলেজের ব্যান্ডের লিড সিঙ্গার। বিকেলের উদাসী আকাশের মত চোখদুটো। মেয়েরা জাস্ট পাগল জিশানদার জন্য। কিন্তু জিশানদা কখনও মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত।
‌জিশানের গলাটা নরম হলেও কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা জন, ক্যাংলাদের বাধ্য করল সরে যেতে। ওরা সরে গেলে নির্ঝরকে বললো,
‌— তোর নাম নির্ঝর, না?
‌নির্ঝর তো লজ্জায় একশেষ। জিশানদা তার নাম জানে! নির্ঝরের হাতে হাত রেখে জিশান সেইরকম নরম গলায় বললো,
‌— আজ থেকে আমরা বন্ধু। কেমন!
‌সারা গায়ে শিহরন খেলে গেল নির্ঝরের।
‌ ৩
‌দুটো দিন যে কীভাবে কেটে গেল ঝিঙে জানেই না। আরে ব্রো ! দুগ্গা পুজো বলে কথা। কাজ কি কম পড়িয়াছে? সপ্তমীর দিন কলা বৌ চানের সময় তো ঘুম চোখে ঘোষ কাকুকে ঘষেই দিল। কাকু কড়া চোখে তাকাতেই ঝিঙে একেবারে বিলা। যেন কিছুই হয়নি। একে ষষ্ঠীর দিন ওই ঘটনা, তার রেশ তো কাটতেই চায় না। তার ওপর হবি তো হ, ঘোষকাকুর সঙ্গে এই ঘটনা। আসলে সেদিন প্রথম ঝিঙের সঙ্গে কথা বলেছিল শামুক। বলেছিল –
‌তোমাদের ফেসবুক লাইভটা কখন আছে অষ্টমীর দিন?
‌ঝিঙের হৃদপিণ্ডটা পুরো প্রভুদেবার মত নাচানাচি করছে তখন। সেই নাচের তালে ভেসে যেতে যেতে ঝিঙে তোতলাতে তোতলাতে বলল—
‌মা.. ম্মা.. মা আ আ আ নে এ এ, ওই ওই অস অস অষ্ট মীর দি ইইই নে রা আআআ ত আআআ ট ট টায়।
‌তুমি কি আমায় দেখে তোতলাচ্ছ? এমনিতে তো তোমায় তোতলাতে দেখিনি। আর সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে দেখছি আমাকে দেখে তোমার ফিউজ উড়ে যায়। কেন? আমি কি হাইটেনশান ওয়্যার?
‌না আআআ। মা মা আআআ নে এএএ । তো তোমার গলাটা এ এ এতোওও সুন্দর আমার মানে কি বলবো,… মানে মোনালি ঠাকুর, শ্রেয়া ঘোষাল আর নেহা কক্করের ককটেল লা আআআ……..
‌আবার তোতলাবে তো সোজা এক ছোবলে ছবি করে দেবো।
‌সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে তোমার গান শুনে আসছি শিরিনদি। ঝিঙে এবার সোজা হয়ে বলে। তোমার গানে রূপকথারা গল্প বলে শিরিন… ইয়ে মানে শিরিনদি। কি জানি তোমায় দেখলেই হ্যাপি প্রিন্স এর ছোট্টো সোয়ালো হয়ে যাই আমি। চুপ করে বসে থাকি তোমার হৃদপিন্ডটার পাশে। বয়ে যায় অনন্ত সময়। আমি উঠতে পারিনা। ….
‌মাথা নীচু করে তাকিয়ে থাকে ঝিঙে ….. নির্ঝর।
— আর তোমার আবৃত্তি ? তারা বুঝি না বলা ছবি হয়ে যায়না? বহু বহুবার শুনেছি তোমার কবিতা। রেকর্ড করেছি। রাতে জ্যোৎস্না যখন বরফের কুঁচির মতো ঢেকে দেয় আমার পৃথিবী, আমি তখন তলিয়ে যাই …. তোমার কবিতায়….
‌শিরিনদি, আমি … আমি মানে ….
‌থাক। ঘটা করে আর শিরিনদি বলতে হবে না। হলামই বা এক বছরের বড়ো, বন্ধুকে কি কেউ দিদি বলে? শামুক বলবে, কেমন! তোমার….. শামুক।

‌দূর থেকে দেখা যায় ঘোষকাকু আসছেন। শামুকের বাবা। ত্রস্ত পায়ে যেতে যেতে শামুক বলে,
— অষ্টমীর দিন সাড়ে আটটায় অঞ্জলি দিতে আসব। হলুদ পাঞ্জাবিটা পরবে কিন্তু।
‌বোলতি বনধ্ হয়ে গেছে ঝিঙের। শামুককে যে হলুদ শাড়িটা পরতে বলবে, সেটাও ভুলে গেছে।

‌ ৪
‌‘‌আলোড়ন’‌ এর পর বেশ ভাব হয়ে গেল জিশান আর নির্ঝরের। নির্ঝরের বাড়ি বর্ধমানে। আর জিশানের বসিরহাট। দুজনেরই প্রায় গ্রাম থেকে প্রথম কলকাতার নামী কলেজে পড়তে আসা। আড় ভাঙতে টাইম লাগছিল ঝিঙের। কলকাতার চটপটে খাবার, ঝকঝকে রাস্তা আর টকটকে মেয়েরা ঝিঙের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া ;- শিরিন ঘোষ। একে সিনিয়ার দিদি, তায় ক্যাট দেখতে, কিন্তু ওই যে বলেছিলাম – প্লাজমার ঝলকানি, ওতেই ঝিঙে বধ হয়ে গেল। ঝিঙের আবৃত্তিটা ছোটোবেলা থেকেই মারকাটারি। এদিকে শামুক গায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। ব্যাস ! আর কি! ফাংশানে ফাংশনে ঝিঙে কাটা চাঁদিয়ালের মতো সেই যে লাট খেতে শুরু করল আর মাটিতেই নামতে চায়না। জিশান কত বুঝিয়েছে,
—‌ওরে! আর ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকিসনি। এগো বাবা। ও ক্যাটরিনা তোর মতো রচপাল যাদবের জন্য নয়রে পাগলা। ওর ভিকি কৌশল আলাদা।
‌কিন্তু চোর কবে আর ধর্মের কাহিনী শুনেছে। ঝিঙের একসময় তো মনে হত জিশানদাই শিরিনদিকে ভালবাসে। তারপর বুঝতে পারল তা নয়। ফেস্টের পরেই জিশান ওকে বলেছিল জিশানের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে উঠে আসতে। ওখানে জিশান একাই থাকে। নিজে রান্না করে। নির্ঝর থাকলে সুবিধাই হবে। দুজনে পড়াশোনা করবে আর ভাগাভাগি করে এটা ওটা করে নেবে। টাকা? নাঃ! জিশান বলেছিল ভাড়া লাগবে না। এটা ওর এক কাকুর। ঝিঙে সপ্তাহে তিনদিন বাজার করে দিলেই জিশান বাকিটা সামলে নেবে। কলকাতায় এসে হস্টেলের প্রায় অন্ধকার ঘরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া নির্ঝর প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিল। জিশানের হাতের রান্না অসাধারণ। ঝিঙের দিকে নজরও খুব। মাসখানেকের মধ্যেই ঝিঙের চেকনাই বেড়ে গেল। ঝিঙে লক্ষ্যই করল না যে আরও একজন ওকে ক্রপ করছে আড়াল থেকে ; – শিরিন। খালি কোনও কোনও রাতে চাঁদ যখন মাটিতে নেমে আসত, গভীর ঘুমের অতলে ঝিঙে ওর শরীরে অনুভব করতো একটা স্পর্শ, সাংঘাতিক অতলস্পর্শী আবেগের চোরাস্রোত যেন। চমকে উঠে ঝিঙে দেখত কেউ কোথাও নেই। স্বপ্ন দেখছিল নাকি? ; – শিরিন? কিন্তু……. স্বপ্ন এত স্পর্শসুখ দেয়? বারান্দায় এসে দাঁড়াতো ঝিঙে। দেখতো, জিশানদা শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে তারাভরা আকাশের দিকে। চোখ বেয়ে নামছে গোদাবরী। কী দেখছে ও? কাকে ভালবাসে জিশানদা?

 


‌ ৫
‌— এই যে দাদা, ফুলগুলো দিন। কি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন অমন করে?
‌— শামুকের কপট ট্রোলটা শুনতেই পেল না ঝিঙে। এ কি দেখছে ও? এত খুনখারাপি দেখতে কোনও মেয়ে হয় এই পৃথিবীতে? এ মেয়ে তো পৃথিবীর নয়, মহাশূন্যের ওপার থেকে ভেসে এসেছে। ছায়াপথে ছায়াপথে উড়ে বেড়াত মেয়েটা। কোনও অদ্ভুত সিগন্যালে মণ্ডপের মানমন্দিরে নেমে এসেছে। হলুদ চাঁপা ফুলের মতো ফুটে আছে অষ্টমীর এই সকালে। সত্যিই হলুদ শাড়িতে শামুক ঝিঙেকে স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে।
— এই যে দাদা! ফুলগুলো দিন। আর দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করুন। — জিশানের আলতো হাতের চাপে ঘোর ভাঙে ঝিঙের।
‌সেই অঞ্জলির পর ঝিঙে অনেক চেষ্টা করেও শামুকের নাগাল পায়নি। ওর উতলা মন দেখে জিশানই খবর নিয়ে এসেছে যে বিদেশ থেকে শামুকের মাসি মেসো এসেছেন। তাদের সাথেই শামুক প্যান্ডাল হপিং করছে।
‌— নির্ঝর, ডাটাগুলো ফালতু খরচা করছিস। ও ক্যাটরিনা তোর ফিল্ম এর হিরোইন হবে না। কবে কি চোখ নাচিয়ে দিল আর তুইও ব্যোমকে গেলি। ওরে ভাল করে দেখলে ভালোবাসার মানুষকে ঠিকই চেনা যায়। অত ক্যালাস না, একটু চেত্তা মার। চল্ চল্, ঘুরে আসি। — জিশান প্রায় জোর করেই ঝিঙেকে নিয়ে বেরোয়।

‌ অষ্টমীর রাত পেরিয়ে আসে বাঙালির চিরকালের না ছাড়তে চাওয়া নবমীর নীশি।
‌বিরিয়ানি কিনে বাড়ি ফিরছিল ঝিঙে। চিকেন চাপ বানিয়েছে জিশান। অপেক্ষায় আছে নির্ঝরের। প্যান্ডেলের পেছনের রাস্তাটা দাবার বোর্ডের মতো। আলো আর অন্ধকার গা জড়াজড়ি করে আছে। ঝিঙে অন্যমনষ্কভাবে পা চালিয়ে আসছিল। হঠাৎ তার ডান হাতটায় লাগলো একটা মেগাবাইট টান। ঝিঙে দেখল ওর শরীরটা বাতাসে ভর করে সোজা ধেয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশে বটগাছটার কান্ডের দিকে। ঠিক তখনই বটগাছটাকে আড়াল করে দাঁড়াল একটা পশমের মতো শরীর। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত
‌ক্রিয়ায় ঝিঙের দু হাত প্রসারিত হল আশ্রয়ের খোঁজে। সেই আলিঙ্গনে ধরা পড়ল রূপকথা,… শামুক।

দীঘল চুম্বনের প্রথম আশ্লেষ কাটতে কাটতেই ঝিঙেও নিজেকে ডুবিয়ে দিল গোলাপের পাপড়ি ভরা ঠোঁটে। বাতাস থেমে গেল অদ্ভুত আচ্ছন্নতায়। আদরের আতিশয্যে শামুকের ফিসফিসানি শোনা গেল,
—‌কাল আমায় সিঁদুর দিবি! ……..প্লি ই ই ই ই জ জ জ।

সেদিন ফিরে ঝিঙে একটাও কথা বলল না।
‌জিশান অনেক জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পায়নি। কেবল অনেক রাত্রে কবিতার খাতা খুলে বসল নির্ঝর। লিখল মনের কথা,……
‌‘‌কতটা প্রজন্ম পেরিয়ে তবে,
‌ আমাদের একক অস্তিত্ব বিলীন,
‌ তারায় তারায় স্বপ্নেরা বয়ে যায়,
‌ এতটা প্রজন্ম পরে, ‘‌আমার’‌ শিরিন।।

‌ প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যায়,
‌ কত না প্রজন্ম আমরা পাশাপাশি,
‌ সময় সংখ্যায় কবেই বদলে যায়,
‌ আবহমানকাল আমাদের ভালোবাসাবাসি।।”
‌ ৬
‌‘‌টুম্পা সোনা, একটা হাম্পি দেনা
‌মাইরি বলছি, আমি খৈনি খাব না…..’‌

‌ভাসানের গান বাজছে মাইকে। তালে তালে পড়ছে পা। নড়ছে কোমর। দুলছে পৃথিবী। অতিমারিকালে অতিনিয়ন্ত্রণে সবকিছু। তবুও আবেগ, অনুভূতি বেয়াদব বড্ড। আর ভাইরাস মারবে ভালোবাসাকে? এতো শক্তি ভাইরাস পায়নি এবং পাবেও না কখনও। ভালবাসা এখনও সাবিত্রী। মৃত্যু অথবা মৃত্যুর মতন তে কোনও ধংসের উদ্ধার মন্ত্র সে এখনও।

‌জিশান সেই সকালেই কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে। ঝিঙেকে বলে গেছে দেখা হবে ভাসানের সময়। ঝিঙে বেশি কিছু জানতে চায়নি। মন তার আগমনীতে ভরে আছে এই বিসর্জনের দিনে। দেবীর বরণ করছিলেন ঘোষ কাকিমা। ঝিঙে দেখল, রক্তাম্বরী হয়ে উঠেছেন মা। অথচ এ রক্তিম যন্ত্রণার লোহিত কণিকা নয়, এ হল সমর্পণের আরক্ত প্রকাশ। ঝিঙে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অর্ধ বিবস্ত্রা প্যান্ডেলের পাশটায়। এগোল শামুকও। লাল পাড় সাদা শাড়ি শামুক আজ বড্ড মায়াবী। ঝিঙে সামনে ঝলমলিয়ে উঠল অনাদি অনন্ত প্রেয়সী উচ্ছলতা। স্তব্ধবাক ঝিঙে শামুকের হাত ধরে চলে এল সেই লাল কাঁকড়ার সৈকতে যেখানে একদিকে ভালবাসার পাহাড়কে সাক্ষী রেখে মগ্নতার সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সমর্পণের আরক্ত সূর্য। ডানহাতের বিবশ ছোঁয়ায় সেই রং মন্ত্রের মতো আঁকা হয়ে গেল শামুকের কপালে। দুজনেই সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। আজ আসলে শব্দের বিসর্জন। উন্মোচনের চেয়েও ভালবাসা আজ পর্দানসীন। প্রাচীনতম বাঁশির ডাক শুনে খুঁজছে অন্ধকারের কুঞ্জবন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ওরা। ঠাকুর তোলা হচ্ছে গাড়িতে। কাছেই মিত্তিরদের পুকুর।

‌ঝিঙে দেখলো জিশান দাঁড়িয়ে আছে একটা জারুল গাছের নীচে। শামুকের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ওর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শামুক আস্তে আস্তে বললো,-
‌- বিজয়ার কোলাকুলিটা ?
‌শামুকের ঠোঁটে আঙুল রেখে ঝিঙে নরম গলায় বললো,-
‌চুপ। বিজয়া বলতে নেই। বলো আগামী….। ভাসান দিয়ে ফিরে এসে দিচ্ছি। তখন কিন্তু পালাতে পারবে না!
‌ধ্যাৎ! ……..
‌মনের গভীরে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে জিশানের কাছে পৌঁছে ঝিঙে দেখলো লাল হয়ে যাওয়া চোখ মেলে ওরই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিশান। কাছে যেতেই বললো,-
‌- চল্। ঠাকুর ধরবি না?
‌- তুমি! তুমি নেশা করেছো? জীশানদা?
‌- করলেই বা! তোর কি? তাছাড়া আজ ভাসান । জলেই যখন সব কিছু ভাসবে তখন শুকনো থেকে লাভ কি?
‌জিশানের গলাটা কেন যে আজ অদ্ভুত লাগছে ভাবতে ভাবতেই ঠাকুরের পায়ের কাজটা ধরে জলে ভেসে পড়ল দুজন। ঢাকের আওয়াজ, ‘বলো দুগ্গা মাইকি’ র শব্দ আর অজস্র মুখের আড়ালে ঢেকে গেছে শামুক। ঝিঙে গলা বাড়িয়ে দেখতে যাবে , ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
‌একটা শক্ত হাতের বজ্র আঁটুনি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো ঝিঙের গলা। আতঙ্কিত ঝিঙে হাত পা ছুঁড়ে সে নাগপাশ থেকে বেরোনোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বিস্ফারিত চোখে দেখলো,- তার প্রিয় বন্ধু ;- জিশানদা। জলের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে ঝিঙে জিশানের হিসহিসে গলাটা শুনতে পেলো,-
‌‘‌এতো করে বললাম, তবু শুনলিনা, না? কবিতা করা হয়েছে? আমার শিরিন! জানিসনা? বুঝিসনা? জিশানের মতো পারবে, শিরিন তোকে ভালোবাসতে? জিশান তোকে সব দিয়েছে; তাও শিরিন?
‌শোন্! তুই আমার হলিনা তো তুই কারোর হবি না…..’‌
‌ * *. *. *. *. *

‌ভাসানের পরের দিন ,-
‌স্থানীয় সংবাদপত্র,-
‌‘‌গতকাল স্থানীয় একটি ক্লাবের ঠাকুর ভাসানের সময় একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ক্লাবের দুই সদস্যের সলিল সমাধি ঘটে। মৃত ব্যক্তিদের নাম যথাক্রমে – নির্ঝর সেনগুপ্ত ও জিশান আলি। জলে ঠাকুর ডোবানোর সময় অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে অসতর্ক হয়েই এই মৃত্যু মনে করা হচ্ছে।’‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.