বিধানবাবু ও একটি আটপৌরে সভা

সেঁজুতি সেনগুপ্ত

আমার জন্ম বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর অনেক পরে। সুতরাং, তাঁকে কাছ থেকে দেখা তো দূরের কথা, দূর থেকে দেখার কোনও সুযোগও আমার সামনে ছিল না। তাঁর সম্পর্কে যেটুকু জানা, তা মূলত তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা পড়ে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে লেখা কি অনধিকার চর্চা?‌ তাই যদি হয়, তাহলে তো রবি ঠাকুরকে নিয়ে কিছুই লেখা চলে না। এমনকী উত্তম কুমার বা সত্যজিৎ রায়কেও কখনও চোখে দেখিনি। তাঁদের নিয়েও লেখা চলে না। সে অর্থে কোনও দিকপালকে নিয়েই লেখা চলে না। আবার এঁদের নিয়ে লেখা গেলে বিধান রায় নিয়েও লেখা যায়।

ভনিতা থাক। একটি একেবারেই আটপৌরে সভার কথা তুলে ধরা যাক। বর্ষীয়াণ সাংবাদিক চিরঞ্জীবের লেখা থেকে ঘটনাটা জেনেছি। মনে হল, বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের কাছে তা তুলে ধরা জরুরি। সময়টা পাঁচের দশকের মাঝামাঝি। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে ছাত্রদের একটি সভা। সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার কথা বিধানচন্দ্র রায়ের। কাছেই তাঁর বাড়ি। তাই গাড়িতে নয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটেই চলে এলেন সভাস্থলে। বিশেষ নিরাপত্তাও ছিল না। কয়েকজন কনস্টেবল। আলাদা কোনও মঞ্চও ছিল না। শুধু একটা ছোট্ট লাউডস্পিকারে তিনি কয়েকটি কথা বলবেন। সভায় তখন মেরেকেটে শপাঁচেক ছাত্র। চার–‌পাঁচশো লোক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সভা!‌

bc roy24

মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দেওয়া মানেই গুরুগম্ভীর একটা ব্যাপার। তিনি দেশের কথা বলবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা বলবেন। রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে নিজের ঢাক পেটাবেন। ছাত্রদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেবেন। আমরা এগুলো দেখতেই তো অভ্যস্থ। কিন্তু তিনি বিধান রায়। এসব কোনও রাস্তাতেই গেলেন না। তিনি একেবারে আটপৌরে ঢঙে বলা শুরু করলেন। শুরুতেই বললেন, তোমাদের মধ্যে কে কে ডাক্তার হতে চাও?‌ দশ–‌বারো জন হাত তুললেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তার মানে বাকি সবাই রোগী!‌ হাসির রোল উঠল।

এবার বললেন, ভাল ডাক্তার কিন্তু বেশি ওষুধ দেয় না। এটা মাথায় রেখো। ভবিষ্যতের ডাক্তারদের উদ্দেশে বললেন, বর্ষাকালে সর্দি–‌কাশি–‌জ্বর নিয়ে লোক আসবে। আর বিয়েবাড়ির সময় অম্বল, গ্যাস, পেটের গণ্ডগোল। এই মাথায় রেখে চিকিৎসা করতে হবে।’‌ এরপর বাকি সবার উদ্দেশে বললেন কয়েকটা জরুরি কথা, ‘‌যেটা খেতে ভাল, সেটা পেটের জন্য ভাল নয়। আবার যেটা পেটের জন্য ভাল, সেটা খেতে ভাল নয়। মুখরোচক খাবার বেশি খেও না। চানাচুর, সিঙ্গাড়া, ভাজাভুজি থেকে দূরে থাকবে। ওতে পেটের গণ্ডগোল বাড়ে। ‌অনেকে ভাবে, পেট ভরে খাওয়া বোধ হয় খুব ভাল ব্যাপার। এটা একেবারেই ভুল। সবসময় পেটে জায়গা রেখে খাবে।’‌

এবার এলেন দইয়ের প্রসঙ্গে। ‘‌ভোজবাড়িতে লুচি, মাংস, মাছ নিশ্চয় খাবে। তবে শেষপাতে মিষ্টি দইটি খেও না। ওটি কিন্তু বিষ। তোমাদের সব খাওয়া মাটি করে দেবে। তবে টক দই খেতেই পারো। তাতে ভাল হজম হবে। মিষ্টি দই কিন্তু একেবারেই নয়। আরও একটা কথা খুব ভাল করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। খেতে খেতে জল খেও না। এমনকী খাবার সঙ্গে সঙ্গেও জল নয়। খাবার বেশ কিছুক্ষণ পর জল খেতে পারো।’‌

মূলত এসব নিয়েই ভাষণ। ভাবা যায়, একজন মুখ্যমন্ত্রী এরকম বার্তা দিচ্ছেন! গল্পের ছলে কত ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে দিলেন।‌ কোনও লড়াইয়ের কথা নয়। দেশের স্বার্থে প্রাণ বাজি রাখার কথা নয়। অথচ, তাঁর যা পাণ্ডিত্য, যে কোনও বিষয় নিয়েই কথা বলতে পারতেন। আসলে, অল্পবিদ্যা সবসময়ই ভয়ঙ্করী। প্রকৃত জ্ঞানীরাই এমন সরল হতে পারেন। একেবারেই আটপৌরে সভা। কিন্তু মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কথা। যাঁরা ছাত্রসমাজের জন্য বিরাট কোনও বার্তা নিয়ে হাজির হন, তাঁদের কথা হারিয়ে যায়। সভার পরেই লোকে ভুলে যায়। তিনি একেবারেই সাধারণ কথা বলতে পারতেন বলেই, এত বছর পরেও তাঁর কথা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাই এই আটপৌরে সভাই স্মরণীয় হয়ে থেকে যায়। ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.