আড্ডা নিয়ে লেখা গান, তৈরি হল নতুন ইতিহাস

প্রয়াত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’‌র কথা উঠলেই সবার মাথায় যে গানের সুর গুনগুন করে ওঠে, সেটি নিঃসন্দেহে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।’‌ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল বন্ধুত্বের চিরন্তন সম্পর্কের এই কালজয়ী গানের গড়ে ওঠার ইতিহাস।

কফিহাউজ গানটি নিয়ে মান্না দে সবসময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেন গীতিকার ও সুরকারকে। বিনয়ী মান্ন দে’‌র মতে, তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হত, আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতার পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির সৃষ্টিও হয়েছিল বেশ নাটকীয়ভাবে।

১৯৮৩ সালের কথা। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দে’‌র জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরীপ্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা।
সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরীপ্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজা করেই বলেন, ‘‌কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?’‌
এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, ‘‌কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।’‌

এবার গৌরীপ্রসন্ন বলেন,
‘‌তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?’‌
সুপর্ণ তখন বলেন, ‘‌কেন নয়?‌ কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো।’‌
এই তর্কের মাঝেই গৌরীপ্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।’‌ সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পুজোয় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরীপ্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন করলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরীপ্রসন্ন। তখনই তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’‌দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরীপ্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক।
শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন-

‘সেই সাতজন নেই, আজও টেবিলটা তবু আছে।’‌
কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে, একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
‘‌সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই’‌
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এল গেল কতজনই আসবে, কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।

‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.