সন্দীপ লায়েকের গল্প— শনি ঠাকুর

‌গল্প
শনি ঠাকুর
সন্দীপ লায়েক

শিয়ালদা স্টেশন। শুক্রবার, রাত সাড়ে দশটা। মানুষজনের ভীড় কমে এসেছে। রাস্তার আলোগুলো গোটা দিনের ধোঁয়া ধুলোর সঙ্গে মিশে কিছুটা ম্রিয়মান। ঘর ফিরতি মানুষের পায়ে রাত্রে ক্লান্তির ছাপ মোছাতে শেষ ব্যস্ততা।

রাত পোহালেই শনিবার। চাকরিজীবী মানুষের উইকেন্ড। তাই বলে দীনেশের ক্লান্তি নেই। বরঞ্চ শনিবারের ব্যস্ততা সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর চেয়ে সবচেয়ে বেশি। আসলে এই শনিবার গুলোতেই বাড়তি কিছুটা টাকা কামিয়ে নেয়ার সুযোগ।

শিয়ালদা মেন লাইন থেকে বেরিয়ে ডান দিক ধরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড ধরে এগিয়ে গেলে ফ্লাই ওভার শেষ হওয়ার আগে যেখানে কাইজার স্ট্রিট শুরু হচ্ছে তার আগে দীনেশের কর্মক্ষেত্র। কর্মক্ষেত্র মানে আসলে একটা রংচটা টেবিল। ফ্লাইওভারের গা ঘেঁষে সেটা দাঁড় করানো। টেবিলের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা শনিঠাকুর। তার সামনে একটা পেতলের থালায় হলুদ মেশানো জল। সেই জলে দু একটা ফেলে রাখা এক, দুই, পাঁচ দশ টাকার কিছু কয়েন।

আগামীকাল ভোরের জন্য শনিঠাকুরকে তৈরি করে নিচ্ছে দীনেশ। টেবিল পরিষ্কার করে ঠাকুরের গা মুছে গলায় একটা মালা পরিয়ে দিল সে। তারপর কাঁসার থালাটায় পয়সা গুলো ফেলে জল ঢেলে দিল। থালায় জল থাকলে সেই জলে দূর থেকে কেউ পয়সা ছুড়ে দিলে পয়সা ছিটকে দূরে পড়বে না এজন্যই এ ব্যবস্থা।

কিছুটা দূরেই একটা ফোল্ডিং টেবিলে একটা ঘুগনির হাঁড়ি নিয়ে বসে দীনেশ। শনি ঠাকুরের থালার দিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকে তার। দুপুরে ও রাত্রে ঠাকুরের থালা থেকে বাড়তি পয়সা তুলে নিয়ে রেখে দেয়। সারাদিন কাস্টমারকে পাতার ঠোঙায় ঘুগনি দিয়ে তার ওপর কিছু পেঁয়াজ, লংকা ছড়িয়ে লেবুর রস ছড়িয়ে দেয় সেই সঙ্গে আড়চোখে দেখে কতজন ঠাকুরকে প্রণাম করলে কতজন টাকা জলে ফেলল।

এই শিয়ালদা চত্বরে তার তো আর কম দিন হল না, নেই নেই করে পনের বছর তো হবেই। ওই টেবিলটুকু পাতার জন্য তাকে কম কিছু করতে হয়নি। কারণে অকারণে পার্টির ঝান্ডা ধরতে হয়েছে, অন্যায় করতে হয়েছে, সবশেষে টাকাও দিতে হয়েছে।

কিছুটা দূরের একটা চায়ের দোকানে সে ও আরেকজন ঘুমায়, কিছু ভাড়াও দেয়।

এবার তার ইচ্ছে ব্রিজের তলায় একটা জায়গা নেবে আর অন্য একটা দোকান খুলবে। টাকা জমা করেছে অনেকটাই। নিজে যেটুকু করে সেটুকু সে নিজের খরচ চালায়, বাড়িতে পাঠায়।
শনি ঠাকুরের পায়ের তলার টুকু সে খরচা করে না, সেটুকুই সে তুলে রাখে নতুন ব্যবসার জন্য।

রাত এগারোটা বাজলো। দীনেশ, ঠাকুরের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে প্রণাম করল। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে ‘‌ক্ষমা করো ঠাকুর, তোমাকে দিয়ে ব্যবসা করতে আমার ভাল লাগে না। কথা দিচ্ছি নতুন দোকান খোলার পর তোমায় আমি দোকানে তুলে রাখব, তোমার পায়ের নিচে থালা পাতবো না।’‌

চোখ খুলে আস্তে আস্তে পা বাড়ায় চা দোকানের দিকে, এবার শুয়ে পড়তে হবে। ভোর হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা..‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.