মৌতান ঘোষাল
সময়টা ৫০এর দশক হবে। শুকতারা’র অঙ্কন ও অলঙ্করণে’র কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই প্রস্তাবটা এসেছিল বাংলায় কমিক্স তৈরি করার। নতুন ধরনের কাজের ইচ্ছা থেকে চ্যালেঞ্জটাও নিয়েই ফেলেছিলেন হাওড়া শিবপুরের সেই সৃজনশীল মানুষটা। ভাগ্যিস নিয়েছিলেন! নাহলে যে প্রায় ৬টা দশকের হাজার হাজার বাঙালি শিশু আর কিশোরের ছোটবেলাটাই একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যেত সাদা-কালো ছবির ওই দুই ‘বিচ্চু ছোড়া’র দুষ্টুমি ছাড়া। প্রিয় পাঠক, ঠিক ধরেছেন। বাঙালির প্রথম কমিক সুপারম্যান “বাঁটুল দি গ্রেট”ের শ্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের কথাই বলছি। এই বছরই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে “ডিলিট” উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতে চলেছে। ৮ই মে অনুষ্ঠান।
কেমন আছেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি ? কীভাবে কাটছে সময়? এখনও কি সৃষ্টিশীল ? স্মৃতির সরণি বেয়ে হাঁটতে টিক কেমন লাগে ? এসব নানা জিজ্ঞাসা নিয়েই একদিন হাজির হয়ে গেলাম তাঁর বাড়ি। ঠিক প্রথাগত গুরুগম্ভীর সাক্ষাৎকার নয়। বরং, একটু খোলামেলা আড্ডা। সেই আলাপচারিতারই কিছু নির্যাস তুলে দেওয়া হল পাঠকদের জন্য।
প্রশ্নঃ সুখবরটা পেয়েছেন তো?
নারায়ণ দেবনাথঃ হ্যাঁ। দু’মাস আগে ওঁরা একবার যোগাযোগ করেছিলেন। পরশু চিঠি পেলাম। ভাল লাগছে। কাজের স্বীকৃতি পেলে সবারই ভাল লাগে।
প্রশ্নঃ আপনার সঙ্গেই তো অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ এবং কবি গীতিকার গুলজার সাহেবও সম্মানিত হচ্ছেন। জানেন নিশ্চয়?
নারায়ণ দেবনাথঃ এই দু’জন মহান শিল্পী’র সঙ্গে যে আমাকে একইসঙ্গে রাখা হয়েছে এটাও একটা বাড়তি পাওনা আমার কাছে। আমি নিজে কত বড় শিল্পী, তা জানি না। তবে ওঁদের সঙ্গে এক মঞ্চে এই সম্মান নেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি আপ্লুত।
প্রশ্নঃ আপনার কি মনে হয়না এই স্বীকৃতিগুলো আরও অনেক আগেই আসা উচিৎ ছিল?
নারায়ণ দেবনাথঃ ২০১৩-এ ‘বঙ্গবিভূষণ’ পেলাম। তারপর গোয়ায় ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার। এই বছর এই উপাধি। আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা অনেকেই মনে করে অনেক দেরিতে আমি স্বীকৃতিগুলো পেলাম, কিন্তু আমার তা নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। আমি মনে করি, সময় না হলে কিছু হয় না। হয়তো সেই সঠিক সময়টা এতদিন আসেনি!
প্রশ্নঃ কমিক্স, তাও বাংলা ভাষায়। আইডিয়াটা এল কোথা থেকে?
নারায়ণ দেবনাথঃ ‘দেব সাহিত্য কূটির’ থেকেই প্রস্তাবটা আসে। আমি তখন শুকতারার অঙ্কনের দায়িত্বে। আঁকার পাশি পাশি গল্প লিখে ছোট ছোট কমিক্স বানাতে পারবো কিনা জানতে চান ওঁরা। আমিও ভাবলাম, দেখি একবার চেষ্টা করে । আমাদের একটা গয়নার দোকান ছিল, ছোটবেলায় সেই দোকানের সামনে বসে অনেক ঘটনা দেখতাম, অনেক মজার ঘটনা, বাচ্চাদের দুষ্টুমি। সেইসবের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে তৈরি হল “‘হাঁদাভোঁদার কান্ডকারাখানা”। হাদাভোদা’র সাফল্যের বছরখানেক পর ঠিক হল আরও একটা কার্টুন চরিত্র চাই, সেটা হবে দু’রঙের। এবারও বললাম চেষ্টা করে দেখি। নামটা আগে মাথায় এলো বাঁটুল। তারপর কল্পনা থেকে তার চেহারা বানালাম। ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁটুলকে নামানো হল ওয়ার ফ্রন্টে। সেই থেকে তার দাপাদাপি শুরু, আজও চলছে।
প্রশ্নঃ আপনার পর আর কেউ তো তেমন ভাবে বাঙ্গালি’র নিজস্ব আর কোনও কমিক চরিত্র তৈরিই করল না! অ্যানিমেশনেও সেই বাঁটুল, নন্টে ফন্টেরাই সবেধন নীলমণি! এই আকাল কেন?
নারায়ণ দেবনাথঃ আগ্রহের অভাব। বাংলাতে বিষয়টাকে সবাই তাচ্ছিল্যই বেশি করল। এখন কমিক্স কিছু হচ্ছে, কিন্তু সেসবই নামী লেখকদের গল্প নিয়ে ছবি আঁকা। নতুন কমিক্স চরিত্র আর কই। তবু যারা কাজ করছেন খুব খারাপ না।
প্রশ্নঃ আর লক্ষ্মণ চলে গেলেন, ক্ষতিটা তো অনেকটাই?
নারায়ণ দেবনাথঃ উনি কমিক্স লিখেছেন কিনা জানি না। উনি ছিলেন ব্যাঙ্গচিত্রী। মুলত রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতেন। ওঁর কলকাতা’র স্ট্যাচু নিয়ে একটা বই আছে সেটা দেখেছি, অসাধারণ। এমন কার্টুনিস্ট আর হয়তো কখনও পাওয়া যাবে না।
প্রশ্নঃ “শার্লি এবেদো”র উপর যেভাবে আক্রমণ হল তা কতটা আতঙ্কের একজন শিল্পী’র কাছে?
নারায়ণ দেবনাথঃ বিষয়টা সম্পুর্ণই রাজনৈতিক। সবটাই পড়েছি খবরের কাগজে। এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত আছে। আমাদের পক্ষে কিছু বলা খুব কঠিন। তবে হ্যাঁ, শিল্পী’র নিরাপত্তাহীনতা তো বড় সমস্যা। তবে এটা কম বেশি সর্বত্রই আছে। হয়তো এতটা ভয়ঙ্করভাবে নয়। আসলে সমস্যা হল চিত্র শিল্পীদের তেমন কোনও সংগঠন নেই। একত্রিত হয়ে থাকাটা নিরাপত্তা বাড়ায়। শুধু জঙ্গি হানা কেন? নানা ভাবে বহুবার বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত হয়েছে শিল্পীরা। এটা খুব একটা নতুন ঘটনা নয়।
প্রশ্নঃ এতটা পথ হেঁটে এসে, আজ কোন আক্ষেপ আছে জীবন থেকে?
নারায়ণ দেবনাথঃ তথাকথিত কোনও পুরস্কার পাওয়ার আগে এই প্রশ্নটা খুব শুনতে হত। সেদিনও বলতাম, আজও বলছি। পুরস্কার কী পেয়েছি, কী পাব জানি না, কিন্তু মানুষের কাছে যা ভালোবাসা পেয়েছি তার কোনও তুলনা হয় না। এর থেকে বড় কোনও প্রাপ্তি হতে পারে না একজন শিল্পী’র কাছে। আর তাই আমার সত্যিই কোনও আক্ষেপ নেই।