প্রবাসের গল্প
ওগো বিদেশিনী
মধুজা মুখোপাধ্যায়, নিউ ইয়র্ক
একটু আগে বাংলোর কেয়ারটেকার নিতাই গরম চায়ের কাপ বেতের টেবিলে বসিয়ে হারিকেন আনতে একতলায় নেমে গেল। চটির শব্দ মিলিয়ে যেতেই বাংলোর পেছনের দিক থেকে নদীর জলের আওয়াজ কানে আসছে। বর্ষার বিদায়ের পর স্থানীয় চন্দ্রাবতী নদী জলে টইটুম্বুর। এসব কিছু ছাপিয়ে বাথটাবের কলের ফোঁটা ফোঁটা জলের শব্দ কানের মধ্যে এসে বিঁধছে। আর সমস্ত শরীরে একটা অপরিচিত শিহরণ। একটু আগে যা দেখলাম তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গলে আমার শূন্য দৃষ্টি।
আমি ডঃ অর্জুন মুখোপাধ্যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানী মহলে কিঞ্চিৎ নামডাক। গতমাসে বস্টনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কনফারেন্স সেরে এমাসের গোড়ার দিকে দেশে ছুটি কাটাতে এসেছি। শহর থেকে দূরে পালামৌয়ের কাছে কটা দিন এই বাংলোয় কাটাবো। গতকাল এসেছি। ইচ্ছে ছিল দিন কয়েক থাকার, কিন্তু আজকের পর তা অসম্ভব !
এমনিতে এখানে ইলেক্ট্রিসিটির অভাব নেই। তবে বাংলোর ঘরের আলো টিমটিমে। সকালেই নিতাইয়ের কাছে শুনেছি এটা কোনও সাহেবের ডাকবাংলো। তিনি নাকি খুব স্নানবিলাসী ছিলেন। তাই ব্রিটিশ কায়দায় বাথরুমখানি সাজাতে কোনও কার্পণ্য করেননি। বাথরুমের মাঝখানে পেতলের বাথটাবের সঙ্গে সোনালী হ্যান্ডশাওয়ার। দেওয়াল জুড়ে ফ্লোরাল মোটিফের ওয়াল পেপার। নদীর দিকের দেওয়ালে সোনালী ফ্রেমবন্দি প্রকাণ্ড আয়নার ধারে মোমবাতির ব্যবস্থা। সুগন্ধির বোতল, সাবান, মোলায়েম তোয়ালে দিয়ে রাজহাঁস। আরেক দেওয়ালে সোনার বেসিন। সিলিঙে বাহারি ঝাড়বাতি থেকে মোমের আলো উঁকি মারছে। আয়নার উল্টোদিকের দেওয়ালে এক অপরূপা বিদেশিনীর প্রমাণ সাইজের পোর্ট্রেট। আনমনে তাকিয়ে। চোখের মণি সামান্য নীলাভ। গলায় মুক্তোর মালা। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম। কীভাবে সাহেবের স্নানঘর উপভোগ করব ভাবতে ভাবতে নিতাই গরম জল নিয়ে হাজির। আইপডে ভিভাল্ডির প্লেলিস্ট চালিয়ে এবার সোজা বাথটাবে গিয়ে বসলাম।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেলেছি পেতলের বাথটাবে। জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে জোনাকির আলো। চোখ বন্ধ করে ভায়োলিনের সুরে মনোনিবেশ করেছি। চোখ খুলে সোজা আয়নার দিকে তাকাতেই মুহূর্তের মধ্যে পিঠ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বিদেশিনীর ঘাড় সামান্য বেঁকে গেছে। মুখে স্মিত হাসির বদলে চওড়া হাসি। চোখের পলক পড়ছে। একি ! এ কি করে সম্ভব? সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাথরোব গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসতে না বসতেই কারেন্ট অফ। আর তখনই নিতাই চা দিয়ে গেল। হার্টবিট তীব্র। নিশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। বাথটাবের কল ঠিক করে বন্ধ হয়নি। জলের ফোঁটা ফোঁটা শব্দে মনে পড়ছে দৃশ্যটা। বিদেশিনীর চোখের পলক কী করে পড়ল? নিতাই হারিকেন আনতেই জিজ্ঞাসা করলাম বাথরুমটা ব্যবহার হয় না? বলল আমি আসার কয়েকদিন আগে আরেক বাবু এসেছিলেন। তিনিই শেষবার ব্যবহার করেন। নিতাইকে বললাম আর কোনও ঘর থাকলে খুলে দিতে। ডিসিশন নিলাম কাল ভোরবেলা বেড়িয়ে পড়ব। সারারাত দু’চোখের পাতা এক হল না। ভোরবেলা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেওয়ার সময় নিতাইকে বকশিশ দিতে গেলে ও একটা বন্ধ খাম আমাকে দিল। বলল, আগের বাবু আপনাকে দিতে বলেছিলেন। খামের ওপর আমার নাম লেখা। আর কত চমক বাকি? গাড়িতে উঠে খাম খুলে একপাতার একটা চিঠি পেলাম।
‘অর্জুন, গতমাসে বস্টনে কনফারেন্সের পর এই বাংলোর গল্প বলার সময় তোকে দেখে মনে হয়েছিল তুই আসবি। ডিসনির ম্যাজিক কিংডমের হন্টেড হাউসে রাখা মৃত মানুষের পোর্ট্রেটের চোখের পাতা পড়া নিয়ে সেদিন খুব তর্ক করেছিলি। টেকনোলজির ব্যবহার নিয়ে প্রতিবারের মতো সেবারও আমরা একমত হলাম না। দেশে আসছিস শুনে চান্স নিলাম। কলেজে পরীক্ষায় কোনওদিন হারাতে পারিনি, বাংলোর বিদেশিনীকে কেমন লাগলো জানাস। তুষার’
শাবাশ! বাংলোর রহস্যময় পরিবেশে নিখুঁত লেসার ইল্যুশনের অঙ্কটা মাথায় এল না ? আড়ালে হেসে ফেললাম। গাড়িতে তখন কাল সন্ধ্যের ভায়োলিন ট্র্যাক বাজছে।