বিদায় নিলেন ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বড্ড বেরসিক এক মানুষ। কত লোক হাফ ছেড়ে বাঁচল। সেই স্বস্তির আড়ালে ব্যতিক্রমী শ্রদ্ধার্ঘ্য। লিখলেন রবি কর।।
কথায় বলে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমরা জানি, একইসঙ্গে ধর্ম আর সরকারের পিছনে লাগার মতো পাপ আর নেই। আমরা আরও জানি, লোভে পাপ। পাপে মৃত্যু। লোভ মানে শুধু টাকাপয়সার লোভ নয়। যশের লোভও একধরণের লোভ। সেই লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকেই সরকারের পিছনে, ধর্মের পিছনে কাঠি দিতে চায়। ভাবে টিভিতে মুখ দেখাচ্ছে, কাগজে নাম বেরোচ্ছে- আমি কী হনু রে!
কিন্তু এই সব লোভের ফলে পাপ তো হবেই আর পাপ করলে তো মরতে হবেই। যেমন মরতে হল ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বেশ হয়েছে। বুড়োটা মরিয়া প্রমান করিল, তাহার মতো মানুষ এই দেশে বাঁচিতে পারে না। সত্যি আমাদের মতো ফুর্তিপ্রিয়, সংস্কৃতিবান, সভ্য জাতির মধ্যে তাঁর মতো রসকষহীন, আনকালচারড, অসভ্য মানুষ নেহাতই বেমানান ছিলেন। তিনি পটল তুললেন, এবার বাঙালি জাতির পাকা ধানে মই দেওয়ার মতো আর কেউ রইল না। জয় বাঙ্গালির জয়।
ভাবছেন আমার কথাগুলো বাড়াবাড়ি? না একটুও বাড়াবাড়ি নয়। একটু ভেবে দেখুন, মানুষ যখন জংলি ছিল, তখন সে কি করত! সারাদিন পশু শিকার করে, সন্ধ্যেয় গুহার সামনে আগুন জ্বেলে, হুলা-হুলা করে খালি গলায় কিছুক্ষন গান গেয়ে, নেচে কুঁদে, ঘুমাতে চলে যেত। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবিষ্কার করল, মাইক, ডি জে, ২৮৫ ডেসিবেলের দোদোমা। ব্যস সভ্যতা একেবারে মগডালে উঠে বসল।
আরও ভাবুন, প্রাচীন যুগে মানুষ খালি গলায় আজান দিত, খালি গলায় অং-বং-চং বলে পুজ করত। কিন্তু আমরা সভ্য মানুষরা তেমন আতাকেলানে নই। কালীপুজোর দিনে এমন বোমা ফাটাব, সব অশুভ শক্তি অণ্ডকোষ বার্স্ট করে মরে যাবে। ১৬ টা মাইকে এমন আজান দেব যে বেহেস্তের সব ফেরেস্তা বিষম খেয়ে হেঁচকি তুলে এই যায় সেই যায়। বড়দিনে এমন ডি জে বাজাব যে ব্যাটাছেলেরও গর্ভপাত হয়ে যাবে। – তবে না সভ্যতা!
কিন্তু এই সভ্য সমাজে মূর্তিমান অসভ্যের মতো জন্ম নিয়েছিলেন ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। জগতে আনন্দযজ্ঞে তাঁর মতো নিরানন্দ দুটো দেখিনি। এক কথায় তাঁকে নব-মীরজাফর বলা যায়। বাঙালি যা যা করতে ভালবাসে সবেতেই তিনি কাঠি করে গেছেন। (যদিও শেষমেশ সফল হতে পারেননি। রাজনইতিক দাদা দিদিরা আমাদের মতো সভ্য মানুষদের কথা ভেবে তাঁর সব অপচেষ্টায় থুতু দিয়ে দিয়েছেন। মাঝ থেকে কটা ক্ষুদিরাম বাড় খেয়ে শব্দ-শহিদ হয়েছে। ওদিকে ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ শব্দবাজির ডেসিমেলের সীমা ৯০ ছাড়িয়ে ১৫০ তে উঠে গেছে।)
আচ্ছা আপনারা বলুন তো, হার্টের রুগির লুঙ্গি তাক করে পেটো ছুঁড়ব- মনসা পুজার ফাংশানে রাত তিনটে অবধি বাপ্পি লাহিরি হবে- মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের দিন ছাত্রদের কানের গোড়ায় অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন হবে, এই সব জনহিতকর আনন্দে যে লোকটা জীবনভর বাগড়া দিয়েছে সে মরবে না তো কে মরবে? লোকটা বুঝলই না যে রাত তিনটে না হলে আমাদের সংস্কৃতি জাগ্রত হয় না, আমাদের ঈশ্বররা সবাই কালা তাই তাঁদের পুজার জন্য মাইকের প্রয়োজন হয়। লোকটা আনকালচারড তো বটেই একই সঙ্গে ধর্মদ্বেষীও বটে।
শুধু কি তাই? আমাদের দেশে সব থেকে বড় ধর্ম হল রাজনীতি। সেই রাজনীতির ঈশ্বর ঈশ্বরীদেরও পিছনে লেগেছিলেন তিনি। ভোট পূজার জন্য একটু মাইক বাজাব, তা না হাজার বখেড়া। কবে পরীক্ষা, কোথায় হাসপাতাল, শব্দের সীমা কত, কটা থেকে কটা মাইক বাজবে- এত কিছু মেনে গণতান্ত্রিক দেশে বাস করা চলে?
তিনি কাউকে দেখতে পারতেন না, লাল জমানায় লালের নিন্দা করতেন, নীল জমানায় নীলের নিন্দা করতেন, তাই তাঁকেও কেউ দেখতে পারত না। তাঁর মৃত্যুতে সবাই মুখে শোকপ্রকাশ করছে ঠিকই, কিন্তু মুখে বলছে, বাবা বাঁচলুম! আপদ বিদায় হল। এবার সুভাষ দত্তটা মরলে ষোলকলা পূর্ণ হয়।
[পুনশ্চঃ বিশ্বাস করুন স্যার, আপনার মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করতে চাইনি। কিন্তু কী করব বলুন, রবীন্দ্রনাথের গল্পের সেই বিদূষকের মতো আমিও শুধু হাসতেই পারি। তাই টিটকিরি দিতে দিতেই যা বলার বললাম। আর কেউ না বুঝুক আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন যে টিটকিরিটা কাকে বা কাদের দেওয়া হল।]