ব্রাত্যদা, এমন বোমা! ‘তিনি’ জানলে আপনার দ্বীপান্তর নিশ্চিত

ব্রাত্য বসুর নাটক বোমা। অরবিন্দর ভাই বারীণ ঘোষের সংলাপে কার ছায়া ? সংলাপগুলো যেন চেনা চেনা লাগছে। তিনিও কাউকে বিশ্বাস করেন না, সব কৃতিত্ব নিজে নিতে চান। ব্রাত্যবাবু, ‘তিনি’ যদি জানতে পারেন, কী হবে ? আপনাকেই আন্দামান বা পন্ডিচেরী চলে যেতে হবে। নাটক দেখে এমন নানা বেআক্কেলে প্রশ্ন তুলে ধরলেন রবি কর।।

নাটক জিনিসটা সাধারণত আঁতেলরাই দেখে। শুধু দেখে কেন, যারা নাটক লেখে, যারা নাটকের বই পড়ে, যারা ডাইরেকশন দেয়,অভিনয় করে সবাই কম-বেশি আঁতেল। আমি অবশ্য কোনওদিন নাটক দেখিনি, কিন্তু টিভিতে ‘সঙ্গে সুমন’ দেখে দেখে বুঝে গেছি, নাটক কী ভয়ানক জিনিস! ব্রাত্য-সুমন- অর্পিতা-কৌশিক পৃথিবীতে এমন কোনও বিষয় নেই যা এঁরা জানেন না। সব বিষয়েই গড়গড়িয়ে প্রতিক্রিয়া দেন। বাপরে! রবীন্দ্র সদনের সামনে দিয়ে হাঁটতেই আমার ভয় করে। এই বুঝি কৌশিক সেন বেরিয়ে এসে দুটো জ্ঞানের কথা বলল। জ্ঞানে আমার খুব ভয়। তাই নাটকেও আমার খুব ভয়। মাঝে মাঝে বউকে নিয়ে দেব-মিমির সিনেমা দেখতে যাই। আর ছুটির দিনগুলোতে বাড়িতে দিদি নং ১ দেখি। এর বেশি সংস্কৃতি আমার দরকার নেই।
কিন্তু সেদিন এক বামপন্থী ছোঁড়ার পাল্লায় পড়ে ব্রাত্য বসুর বোমা নাটকটি দেখতে যেতে হল। আপনারা তো জানেন এই বামপন্থীগুলো কেমন অসহ্য টাইপের আঁতেল হয়। মুখ খুললেই মনে হয় লেনিন ঢেঁকুর তুলছে। কথাবার্তা কী বলে কিছুই বোঝা যায় না।
তবুও এই ছোঁড়ার সঙ্গে আমি গেলাম নাটক দেখতে। আসলে মনে একটু কৌতূহল হয়েছিল। বামপন্থী হয়েও তৃনমূলী ব্রাত্যর নাটক কেন দেখতে যাচ্ছে? যাই, আমিও দেখে আসি। কী বলব দাদা, অ্যাকাডেমিতে ঢুকে মনে হল অঙ্কের ক্লাসে ঢুকে পড়েছি। সামনের সারিতে অধ্যাপক-অধ্যাপক চেহারার লোক, দিদিমণি- দিদিমণি চেহারার মহিলা। স্লিভলেস টপ পরা কিছু মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের গলায় টেরাকোটার গয়না, ছোকরাগুলোর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল- দেখলেই বোঝা যায় এরা বুদ্ধিজীবী। ভাবলাম, একটুখানি দেখেই, হিসি পেয়েছে বলে বাইরে চলে আসব। সেই স্কুলে যেমন করতাম, may I go to toilet please? কিন্তু খানিকটা দেখেই আমি চমকে উঠলাম! ব্রাত্যবাবু এ কী নাটক বানিয়েছেন!

boma7

বঙ্গভঙ্গের সময়ে যুগান্তর বিপ্লবী দলকে নিয়ে এই নাটক। এই বিপ্লবী দল বোমা বানায় আর সাহেবদের দিকে ছোঁড়ে। মঞ্চে বিস্ফোরণের কী আওয়াজ! দু-ম-ম-ম। আলোর কী ঝলকানি! গায়ে কাঁটা দেয়। আর কী সব দৃশ্য! মঞ্চে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড়ো হাওয়ায় পাতা উড়ে যাচ্ছে, ক্ষুদিরামের বোমা ছোঁড়ার দৃশ্য মঞ্চে দেখানো যায় না, তাই পর্দায় দেখানো হল। সবাই বলছিল, বাংলা নাটকে এসব আগে কখনও হয়নি।
কিন্তু নাটকে বিপ্লবী বারীন ঘোষ মহা কুচুটে। সবার পোঁ- থুড়ি পিছনে কাঠি দেন। দেখতে দেখতে আমি তো খেপে উঠলাম। অগ্নিযুগের একজন বিপ্লবীকে এমন ছোট করে দেখানো! শ্রী অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ এমন কুচুটে ছিলেন? পাশ থেকে এক বুদ্ধিজীবী বললেন, “শান্ত হন মশাই। টিকিটে লেখা আছে, বোমা A FICTION.” ও তাই বল, FICTION, মানে কল্পনা! কিন্তু এমন কল্পনা ব্রাত্য বাবুর মাথায় এল কেন? এই নাটকে বারীন ঘোষ কি সত্যিই বারীন ঘোষ? নাকি বর্তমান সময়ের কোনও ব্যক্তির ছায়া পড়েছে বারীন ঘোষের চরিত্রের উপরে? নাটকে বারীন কালিভক্ত। বর্তমানের সেই ব্যক্তিও কি কালীভক্ত? কালীতীর্থের কাছাকাছি থাকেন?
ভাবতে ভাবতে ঘেমে উঠলাম। ওরে ও ব্রাত্য! একি নাটক বানিয়েছিস বাপ! (উত্তেজনায় ‘বানিয়েছিস’ বলে ফেললাম, অপরাধ নেবেন না।) হে ভগবান, হে মা কালী, আমাদের ব্রাত্যবাবুকে রক্ষা করো ঠাকুর! “কালী কালী মহাকালী, তোমার বাড়ির ছাদে টালি।” দোষ নিও না মাগো!
boma6

যদি আপনারা নাটকটা দেখতে যান, মন দিয়ে বারীন ঘোষের চরিত্রটা লক্ষ্য করবেন। কি জানি, আমার দেখার সঙ্গে আপনাদের দেখা মিলতেও পারে।
বারীন ঘোষ নেতা হলেও সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। তাঁর বেশবাস সাদামাটা, জীবনযাত্রা সাধারণ। রাতে তাঁর ভালো ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখেন মা কালী খাঁড়া হাতে নাচানাচি করছেন। আর ঘুম থেকে উঠেই খোঁজ নিতে শুরু করেন, দলের মধ্যে কোন নেতার সঙ্গে কার কী রকম সম্পর্ক। একদিন তাঁর এক সহকর্মী উপেন্দ্রনাথ বলেই ফেলেন, “অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তোমার এত মাথাব্যথা কেন বল তো?” বলি ও ব্রাত্যবাবু, কথাটা উপেন্দ্রনাথ বলল না কি আপনি নিজে বললেন? আর বললে কাকে বললেন?
নাটকের বারীন ঘোষ কাউকে বিশ্বাস করেন না। সবাইকে ঈর্ষা করেন। দলের কোনও দুজন নেতা কর্মী নিজেদের মধ্যে কথা বললেই শুরু হয় তাঁর প্রশ্নবাণ।“কী কথা বলছিলে? আমি লিডার, আমাকে বাদ দিয়ে কী আলোচনা তোমাদের? কিসের এত ঘনিষ্ঠতা?” এমনকি পর্দার আড়াল থেকে আড়ি পেতে তিনি অন্যদের আলোচনা শোনেন। কী জানি বাবা! আমার পাপ মনে এই বারীন ঘোষকে কেমন চেনা চেনা লাগছিল। বিশেষ করে বারীন যখন বলেন, “অবিশ্বাসই নেতৃত্বের ধর্ম। আমি নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করি না,” তখন এই চেনাটা আরও স্পষ্ট হয়।
যেটুকু বুঝলাম, নাটকে বিপ্লবী কার্যকলাপের থেকে, দলের ভিতরের রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্রাত্যবাবু তো একাধারে নাট্যকার এবং রাজনীতিবিদ। তাই ১০০ বছর আগের রাজনীতিটা বোঝাতে তাঁর সুবিধাই হয়েছে।। নাটকে নারী বিপ্লবী কল্পনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রাত্যবাবুর স্ত্রী পৌলমী। একটা জায়গায় তিনি বলছেন, “যে নেতা কাউকে বিশ্বাস করে না, শুধুমাত্র তুমি আমার লোক, এর বাইরে কিছু ভাবে না, তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা কি প্রশ্নাতীত?” ওফ কি ডায়লগ মাইরি! শুনে তো আমার পয়সা ছুঁড়তে ইচ্ছা করছিল। নাট্যকার একেবারে বাস্তব জীবন থেকে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছেন। বোধহয় এমন কথা তাঁর মনে প্রায়ই ঘুরপাক খায়।
আবার ধরুন, বারীন ঘোষের হাত ধরে দলে আসা কল্পনা যদি হেমচন্দ্র বা উল্লাসকরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তখন ক্রোধে জ্বলে ওঠেন বারীন। সাফ বলে দেন, “আমার কাছে নিজেকে সমর্পণ কর।” আরও বলেন যে, তাঁর নজর এড়িয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না। কারণ তাঁর ঘ্রাণশক্তি শৃগালের মতো তীক্ষ্ণ। শুনে কল্পনা বলেন, “তাহলে আপনি শৃগালের মতোই বাঁচুন।“
ছিঃ ছিঃ কাকে কী বলছেন কল্পনা দেবী!
দলের কোনও নেতার সঙ্গে বারীনের অন্তরঙ্গতা নেই। একমাত্র উপেন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বস্ত। কারণ উপেনের কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। উপেন তাঁর সব কথা মেনে নেন। তাই উপেনকে তিনি পছন্দ করেন। কী বাস্তব চরিত্র! কিন্তু দলের আর সব নেতার সঙ্গে তাঁর খটাখটি। উল্লাসকরকে তিনি দেখতে পারেন না, কারণ উল্লাস দলের মধ্যে জনপ্রিয়। আর এক জনপ্রিয় নেতা যতীন্দ্রনাথকে তিনি দল থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছেন।
তবু সবাই বারীনের নেতৃত্ব মেনে চলেন। কারণ অরবিন্দের কথায় “ওঁর মধ্যে একটা প্যাশন আছে।” কিন্তু এই প্যাশন এতটাই মারাত্মক যে কারও কোনও ভালো পরামর্শ তিনি শোনেন না। চন্দননগরের ফরাসি পুলিশের কর্তাকে তিনি মারবেনই। অরবিন্দের নিষেধও শুনবেন না। হাবভাব এমন, যেন তিনি অরবিন্দের থেকেও বেশি বোঝেন। আসলে বর্তমানের বারীন ঘোষের মতো নাটকের বারীন ঘোষও নেতৃত্বের পথে সামান্যতম বাধা সহ্য করতে রাজি নন। বাধা পেলেই তাঁর মাথায় “অ্যাকশন অ্যাকশন” বলে পোকা গিজগিজ করতে থাকতে। আর হত্যা তো তাঁর কাছে ছোট ঘটনা।
একমাত্র হেমচন্দ্রের সঙ্গেই তাঁর সংঘাত হয়। কিন্তু হেমকে তিনি ঝেড়ে ফেলতেও পারেন না। কারণ দলের প্রাণভোমরা অর্থাৎ বোমা তৈরির কৌশল জানেন হেম। হেমকে ছাড়া বারীনের চলবে না তাই তাঁকে সহ্য করতে বাধ্য হন। কিন্তু মনে সব সময় ভয়, যদি হেম বা উল্লাস তাঁর থেকে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন?
ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ার পর বারীন পুলিশকে এজাহার দেন। হেমচন্দ্র কিছুতেই দেবেন না। এতেও বারীনের ঈর্ষা। যদি ইতিহাস হেমচন্দ্রকে তাঁর থেকে বড় দেশপ্রেমিক বলে মনে রাখে? তিনি বারবার বলেন, কেন এজাহার দেবে না? এজাহার তোমাকে দিতেই হবে। অর্থাৎ বারীন মনে করেন, তিনি যা করবেন, সবাইকে তাই করতে হবে।
কী সুন্দর সংলাপ, যেন বর্তমানের আয়না।
নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হওয়ায় অন্য দুই বিপ্লবী জেলের মধ্যেই তাকে গুলি করে মারেন। বারীনের সে কী রাগ! “আমি লিডার, আমাকে না জানিয়ে কে এমন কাজ করল? কে সিদ্ধান্ত নিল? আমি লিডার আমার কথা সবাইকে মানতে হবে।” নরেন গোঁসাইকে নিয়ে তাঁর চিন্তা নেই। নেতৃত্ব হারানোর ভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। একে ওঁকে জিগ্যেস করছেন, “কে করল বল তো?”

boma5
কী পাঠক মশাই চেনা চেনা লাগছে? দলে যা হবে সব আমার কথায় হবে। যা করার আমিই করব। ইতিহাসে আমার একার নাম থাকবে। আমার নাম থাকবে সব ভিত্তিপ্রস্তরে, সব বিজ্ঞাপনে আমার ছবি, সব ফিতে আমি একাই কাটব।
নাটক শেষ হল। কিন্তু প্রশ্নগুলো আমার মাথায় ঘুরতেই থাকল। একটা দৃশ্যে বারীন ঘোষ বলেন, “আমি নিজেই একটা মানব বোমা।“ আচ্ছা ব্রাত্যবাবুরও কি মানব বোমা হওয়ার ইচ্ছা হয়েছে? নইলে এমন নাটক কেন লিখলেন?
নাটকে এক বিপ্লবী চরিত্র বলেন, “প্রতিমার পিছনে খড়ের চালাটি আমি দেখে ফেলেছি।“ ব্রাত্যবাবু কোন প্রতিমার পিছনে খড়ের চালা দেখে ফেলেছেন জানি না। তবে এটা নিশ্চিতভাবে জানি, যদি সেই প্রতিমার কানে এই নাটকের খবর যায়, (নরেন গোঁসাইয়ের তো অভাব নেই), আর যদি তিনি নাটকটি দেখেন, আর যদি তিনি বারীন ঘোষের আসল পরিচয় বুঝতে পারেন, তাহলে ব্রাত্যবাবুর দ্বীপান্তর তো হবেই, ফাঁসি হওয়াও বিচিত্র নয়।

পুনশ্চঃ আমার সিট ছিল একদম পিছনের সারিতে। ভালো দেখতে পাইনি। তাই সামনের সারিতে একজনকে জিগ্যেস করলাম, “বারীন ঘোষের পায়ে কি হাওয়াই চটি ছিল?”
শুনে সবাই এমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল যে ভীষণ অপমান হল। যান তো মশাই নাটকের সঙ্গে আড়ি। আর কোনোদিন দেখতে যাব না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.