তোর্সা চ্যাটার্জি
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।“ শুধু জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নয়, মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতেও বিদিশার উল্লেখ আছে।
কবিদের প্রিয় এই বিদিশা নগরী ছিল মালবের রাজধানী। মালবের রাজকন্যা মালবিকাকে ভালবেসেছিলেন তক্ষশীলার গ্রিক ক্ষত্রপের দূত হেলিওডোরাস। মালবিকাকে পাওয়ার জন্য তিনি হিন্দুধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্নবাসুদেব’ গল্পে অমর হয়ে আছে সেই প্রেম কাহিনী।
বিদিশা নগরীর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে আজকের ভোপালের আশেপাশে। ভোপাল রাজধানী শহর। ছোটবড় অসংখ্য হোটেল। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে সাঁচিতে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গেটওয়ে রিট্রিটে যদি ঘর বুক করে, তাহলে শহরের কলাহল থেকে দূরে থেকে পারবেন, আবার সাঁচি, বিদিশার মতো জায়গাগুলির থেকে দূরত্বও কম হবে।
আজকের বিদিশায় সে যুগের গৌরবের বেশি চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মালাদেবী মন্দির, দসাবতার মন্দির, নীলকণ্ঠেশ্বর মন্দির, হিন্দোলা তোরণ, বজ্রমঠ –এসব ধ্বংসাবশেষ দেখলে চোখ কপালে ওঠে। তবে বিদিশার সব থেকে জনপ্রিয় দ্রষ্টব্যটি আছে, বেতোয়া নদীর (প্রাছিন নাম বেত্রবতী) তীরে একটি জেলেদের গ্রামে।
সেখানে একটি তেঁতুলগাছের তলায় আছে, মাঝারি উচ্চতার একটি স্তম্ভ। স্থানীয় লোক বলে ‘খাম্বা বাবা’। দেখতে সাদামাটা হলেও এটি কিন্তু কোনও সাধারণ স্তম্ভ নয়। এটি স্থাপন করেছিলেন তক্ষশীলার গ্রিক যুবক হেলিওডোরাস, যার কথা প্রথমেই বলেছি। কথিত আছে, রাজকন্যা মালবিকার সঙ্গে এই বিধর্মী যুবকের প্রেমে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তাই কৃতজ্ঞ হেলিওডোরাস হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে এই বিষ্ণু স্তম্ভ স্থাপন করেন।
যদি প্রাচীন শিল্পের প্রতি আগ্রহ থাকে তাহলে, হেলিওডোরাসের স্তম্ভ দেখে চলে যান, বিজা মণ্ডল দেখতে। পারমার রাজাদের আমলে নির্মিত এই স্থাপত্য এখন প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেটুকু টিকে আছে তার সৌন্দর্য অতুলনীয়। খোলা আকাশের নীচে যেন একটি শিল্পের মিউজিয়াম।
বিজামণ্ডল যদি সুক্ষ্মতার জন্য নজর টানে, তাহলে বিশালতার জন্য নজর কাড়বে উদয়গিরি পাহাড়ের গুহাগুলি। মৌর্য আমল থেকেই ভারতে পাহাড় কেটে গুহা মন্দির নির্মাণ শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম হল গুপ্তযুগে নির্মিত উদয়গিরি। কোনও গুহায় কার্তিকের মূর্তি, কোনটিতে সপ্তমাতৃকা, সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য, কোনও গুহায় অনন্তশয্যায় বিষ্ণু, কোনও গুহায় পঞ্চলিঙ্গ। গুহার ভিতরে খোদাই করা প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপি, কোনও গুহার বাইরে গুপ্ত যুগের স্তম্ভ।
তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল, ৫ নম্বর গুহার বরাহ মূর্তি। বরাহ মানে বিষ্ণুর বরাহ অবতার। পৃথিবী যখন সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেছিল, তখন বরাহদেব নিজের দাঁতের সাহায্যে ধরিত্রী দেবীকে তুলে এনেছিলেন। গুহার দেওয়ালে তারই বিশাল প্রতিরূপ।
গ্রিক, পারমার, গুপ্ত যুগের শিল্পীদের অসামান্য কীর্তি দেখে, সন্ধ্যায় গেটওয়ে রিট্রিটে ফিরে বিশ্রাম করুন। পারলে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে বা জিমে ব্যয়াম করে শরীরটাকে ছাঙ্গা করে নিন। কারন পরদিন যেতে হবে সাঁচিতে মৌর্য যুগের সৃষ্টি দেখতে।