ধরে নিন, আপনিই অরুণ জেটলি। বা ধরে নিন, আপনিই আপনার সংসারের অমিত মিত্র। নিন, এবার সামলান তো।
আমরা হলাম সেই মধ্যবিত্ত, যারা দিনরাত মন্ত্রীদের গালমন্দ করি। এদিকে, নিজের ছোট্ট সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে উঠি। এদিক সামলাতে গিয়ে ওদিকটা বেসামাল হয়ে যায়। ছেলের আবদার মেটাতে গিয়ে বউয়ের চাওয়াটার মূল্য দিতে পারি না। সারাক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কত জানা–অজানা ঠোক্কর খেয়ে বসি। একটা ছোট্ট ভুলের খেসারত হিসেবে আরও কত ভুলকে ডেকে আনি।
যাঁদের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা, তাঁদের কথা বাদ দিন। যাঁরা মাস মাইনের চাকুরে, বাইরে থেকে দেখে যাঁদের আপাতভাবে সচ্ছল বলেই মনে হয়, তাঁদের সংসারে কখনও উকি দিযেছেন ? তাঁর আয় হয়ত মাসে তিরিশ হাজার টাকা। আমরা ভেবে নিই, মাস গেলে তিরিশ হাজার ঢুকছে, মাত্র তিনটি লোক, কী এমন খরচা! নিশ্চয় অনেক টাকা জমেছে। কিন্তু তাঁর যে নাভিঃশ্বাস উঠছে, সে খবর কজন রাখি! রাজ্য সরকারী কর্মী, কেন্দ্রের কর্মী, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যৌথ পরিবার, স্বামী–স্ত্রী দুজনের চাকরি, নিঃসন্তান, ছেলে–মেয়ে কলেজ পড়ুয়া। এমন নানা দম্পতির সঙ্গে কথা বলা হল। সংসারের খরচের ছবিটা একটু বোঝার চেষ্টা। আসুন, টুকরো টুকরো খরচের হিসেবগুলোয় একটু চোখ মেলানো যাক। সব জায়গায় খরচগুলো একরকম নয়। শহরের সঙ্গে আধা শহরের ফারাক আছে। ছোট পরিবারের সঙ্গে বড় পরিবারের ফারাক আছে। রুচি ও অভ্যেসগত কারণেও ফারাক অনেকটা বেড়ে যায়। কোনও খরচটা একেবারেই অনিবার্য। আবার কোথাও কোথাও হয়ত একটু লাগাম টানা যায়। বিষয় ধরে ধরে একটু আলোচনা করা যাক।
ইলেকট্রিক, গ্যাস, টিভি
একটি পরিবারে ইলেকট্রিক বিল কত? খুব ছোট পরিবার হলেও গড়ে মাসে হাজার টাকা ধরে রাখতে পারেন। শীতে যদি কিছুটা কম হয়, তো গ্রীষ্মে তা বেড়ে যায়। নতুন টিভি কিনলে তো একলাফে খরচটা বেড়ে গেল। যদি পুরানো টিভিও থাকে, কেবল খরচ বাবদ মাসে আড়াইশো/তিনশো। গ্যাসের খরচ বাবদ মাসে আরও ৬০০ ধরে রাখুন। বছরে একটি না একটি নতুন জিনিস কেনা হয়েই থাকে। এই বাবদ গড়ে আরও পাঁচশো ধরে রাখুন। তাহলে ইলেকট্রিক, গ্যাস, টিভি— এসব বাবদ খরচটা মাসে প্রায় হাজার তিনেক দাঁড়িয়ে গেল। আজ বাথরুমে মিস্ত্রী, কাজ
টিভি বা ফ্রিজ খারাপ, পরশু নতুন ফার্নিচার। মাঝে মাঝে রঙ বা মেরামত করা। এসব কারণেও বছরে সাত–আট হাজার চলেই যায়। তার মানে, মাসে অন্তত পাঁচশো।
ই এম আই
ইজি মান্থলি ইনস্টলমেন্ট। নামে ইজি। কাজে মোটেই ইজি নয়। কাবুলিওয়ালার এক কর্পোরেট সংস্করণ। প্রায় সব পরিবারেই এই ই এম আইয়ের চক্করে পড়েছে। নতুন গাড়ি কিনলে মোটা ই এম আই। নিদেনপক্ষে বাইক কিনলেও মাসে হাজার দুই ধরে রাখুন। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিনলেও তাই। আর নতুন বাড়ি বানালে বা ফ্ল্যাট কিনলে তো কথাই নেই। হাউজিং লোন বাবদ মোটামুটি আরও হাজার পাঁচের ধাক্কা। মাস গেলে একটা বা দুটো এল আই সি–র প্রিমিয়াম তো আছেই। ক্রেডিট কার্ড থাকলে সে তো আরেক কাবুলিওয়ালা। তখন কেনার হিড়িক বেড়ে যায়। সুদ
আসলকে ছাপাইয়া যায়। সে যেন শাইলকের বাড়া। তাহলে ই এম আইয়ের চক্করে কত গেল? সবমিলিয়ে নাই নাই করে হাজার দশেক। পুজোর চাঁদা, পাড়ার ক্লাবের চাঁদা, আবাসনের চাঁদা— এমন নানা উৎপাত তো বারোমাস লেগেই আছে। গাড়ি কিনলে ই এম আই কো আছেই। আর মাসে মাসে তেল খরচ কত, সেটাও একটু মাথুয় রাখুন। সেই অঙ্কটা কোনওভাবেই হাজারের কম হবে না।
মুদিখানা, হাটবাজার
চাল, ডাল, নুন, তেল। এসবের বাজেট কত? একেবারে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হলেও অন্তত সাত–আট হাজার। এই মূল্যবৃদ্ধির জমানায় থলি হাতে বেরোলেই হল। দেখতে দেখতে পাঁচশো ফুরিয়ে যাবে। মাছ নিতে ইচ্ছে হলেই দু–তিনশো চলে গেল। চিকেন নিলেও তাই। মটন হলে তো কথাই নেই। চার–পাঁচশো নিমেশে বেরিয়ে গেল। ধরা যাক, মাসে তিন–চার দিন মটন, সাত–আট দিন চিকেন। সপ্তাহে হয়ত দুদিন মাছ। ব্যাস, হিসেব করুন। অঙ্কটা দশের কম হবে হবে মনে হয় না। গৃহস্থালির আরও নানা খরচ। কাজের মাসি ও কেয়ার টেকার মিলিয়ে আরো হাজার ধরে রাখুন। প্রায় সব বাড়িতেই পুজো পার্বণ লেগেই আছে। এমনকি আপাত নাস্তিক বা বামপন্থী পরিবারেও গোপনে হাজার টাকা ঠিক বেরিয়ে যায়। আর ধার্মিক পরিবার হলে তো খরচটা আরও তিনগুন বেড়ে যায়। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা, অতিথি আপ্যায়ন। আপনিও নানা জায়গায় নিমন্ত্রিত। কিছু না কিছু উপহার নিয়ে যেতেও হয়। তার খরচটাও মাথায় রাখবেন।
ওষুধ, ডাক্তারি
সব পরিবারেই রোগ অসুখ লেগেই আছে। ডাক্তারের কাছে গেলেন। তিনি খসখস করে নানারকম টেস্ট লিখে গেলেন। না করিয়েও উপায় নেই। অপারেশন হলে তো কথাই নেই। সবার তো আর কোম্পানি খরচ দেয় না। ফলে,পকেট থেকেই যায়। টুকটাক ওষুধ কেনার জন্য আরও কিছু খরচ। বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকলে এই খরচটা আরও বেশি। যদি মেডিক্লেম করাও থাকে, তারও তো মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম আছে। সব মাসে না লাগুক, সারা বছর চিকিৎসার জন্য কিছু না কিছু তুলে রাখতেই হবে।
মোবাইল
গত এক দু বছরে সবথেকে বেশি খরচ বেড়েছে এই একটি জায়গায়। আগে কথা বললেই হয়ে যেত। কিন্তু এখন প্রায় সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। এক পরিবারে তিনটি বা চারটি স্মার্ট ফোন। বাবারটা কমদামী হলেও চলবে, ছেলের স্মার্টফোনটা হতে হবে আরও আধুনিক। চারটি ফোনের দাম কত ? হাজার তিরিশ। মনে রাখবেন, সবগুলিই
কেনা হয়েছে এই এক দু বছরের মধ্যে। কথা না হলেও চলবে, নেট প্যাক চাই–ই–চাই। এখন না হয় জিও আছে। তারপর ? ওই যে আনলিমিটেডের নেশা ধরে গেল, এবার এক জিবি, দু জিবিতে হবে তো ? চারজনের যদি পাঁচশো টাকা করেও বিল হয়, মাসে দু হাজার গেল। আর কেনার খরচটাও ধরে নিন। তাহলে মোবাইল কেনা ও নেট বাবদ খরচ মাসে অন্তত হাজার তিনেক। কোনও ফোন হারাবে, কখনও ছেলেও নতুন মডেল চাইবে। সবমিলিয়ে এই খরচ আর কমছে না, বরং আরও বাড়বে।
বারো মাস শপিং
আগে কেনাকাটা বলতে শুধু দুর্গাপুজো। বছরে একবার কেনাকাটা করলেই হয়ে যেত। সেই বাজেট তো বেড়েইছে। উল্টে এখন বারো মাস শপিং ফেস্টিভাল। ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন বা স্ন্যাপডিল বারো মাসই কিছু না কিছু অফার দিয়ে চলেছে। আর আপনার গিন্নি সেই ফাঁদে পা দিয়েই চলেছেন। তিনি ভাবছেন তিনি দারুণ বুদ্ধিমতী। কত সস্তায় কত কিছু পেয়ে গেলেন। আজ এটা, কাল সেটা আসছেই। টুকটাক করে এই খাতে বেশ ভালই খসে যায়। আর গয়নার ঝোঁক থাকলে তো দেখতে হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে কী হারে কাগজে, চ্যানেলে ধনতেরাসের বিজ্ঞাপন বেড়েছে, সেটা একবার ভেবে নিন। এখানে খরচের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। তাও যে স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটবে, এমন নিশ্চয়তা একেবারেই নেই।
পড়াশোনা
বাংলা আবার ভাষা নাকি ? ওই ভাষায় আবার লেখাপড়া হয় নাকি ? সরকারি স্কুল আবার স্কুল নাকি? স্ট্যাটাস থাকবে ? সোসাইটিতে মুখ দেখাবেন কী করে ? অতএব...। ছোট থেকেই গোটা চারেক টিউশনি গুঁজে দিন। বড় হলে সব সাবজেক্টের আলাদা টিউটর। ক্যাপিটেশন থেকে নানারকম লুকোনো ফি। আরেকটু বড় হলে, অর্থাৎ ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হলে? মাসে সবমিলিয়ে অঙ্কটা কত ? ভাবতে গেলে মাথার কটা চুল অবশিষ্ট থাকবে, কে জানে!
স্বামীর লুকোনো খরচ
কী ভাবছেন, শুধু স্ত্রীর বায়না আছে ? স্বামীর বুঝি লুকোনো খরচ নেই ? প্রতি দশজনে অন্তত ছজন মদ্যপান করেন। কেউ কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে এক আধবার। আবার কেউ কেউ প্রায় রোজ। মফঃস্বলে এই প্রবনতাটা দিন দিন বাড়ছে। অন্য পেশার লোকেদের কথা বাদ দিন, শুধু শিক্ষকদের মধ্যে সমীক্ষা করুন। চোখ কপালে উঠে যাবে। কোনও কোনও পরিবার ব্যতিক্রম। কিন্তু অনেক পরিবারেই এই বাবদ খরচ প্রায় হাজার পাঁচেক। ধূমপানের নেশা থাকলে সেই কারণেও হাজার দেড়–দুই ধরে রাখতে পারেন।
সিনেমা, রেস্টুরেন্ট
মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার খরচ তো জানেন। ছেলে একা দেখবে না, সঙ্গে বান্ধবীরটা যোগ করুন। সঙ্গে পপকর্ন, ঠান্ডা পানীয়। মাসে এক দুবার রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছে করবে। ওলা বা উবেরেরে অ্যাপস তার মোবাইলে ইনস্টল
করা আছে। দু চারবার নিশ্চয় ব্যবহার হবে। শহরে অনেক এ সি বাস ছুটছে। আপনারও ইচ্ছে হবে, ভিড় বাসে না উঠে এ সি বাসে উঠি। ব্রেক জার্নি হোক, মাঝে মাঝে অটো করে নেওয়া যাবে। ট্যাক্সি বা ওলায় চড়তে আপনারও কি ইচ্ছে না করবে ? ছেলে যদি টিউশন যায়, মাও সঙ্গে যাবে। আসা যাওয়ার অটো। এখান ওখান যেতে গেলে টুকটাক অটো বা টোটো খরচ তো আছেই। সবমিলিয়ে পরিবহন খরচটাও কিন্তু কম নয়।
যেথা খুশি যাইতে পারি
বাঙালি জাতি, বেড়াতে যাবেন না, তাই আবার হয় নাকি? গুপী বাঘাই তো তিন বরের মধ্যে একটি বেড়ানোর বর চেয়েছিল। বছরে একবার সপরিবার বেরিয়ে পড়লেন। স্লিপারে গেলেও চলত, কিন্তু এ সি না হলে অনেকের মুখ ভার। অগত্যা! বাইরে গিয়ে সাইড সিন নামে আলাদা গাড়ি বুকিং। বাঙালি পুরী গেলে, পুরী বাদ দিয়ে বাকি সবকিছু দেখে আসে। আসা যাওয়া বেড়ানো মিলিয়ে খরচ হাজার কুড়ি–পঁচিশ হয়েই যায়। অর্থাৎ, বছরে যদি একবারও যেতে হয়, মাসে হাজার দুই তুলে রাখুন।
এ হল নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক জীবনের খতিয়ান। যাঁরা নানা সামাজিক কাজে জড়িয়ে থাকেন, তাঁদের খরচ আরও বেশি। এমন আরও কত জানা–অজানা খরচ থেকে গেছে। একজনের চাকরি কিছুই নয়। এমনকি দুজনের চাকরির পরেও অনেক পরিবার নাজেহাল। ওই টাকা ফুরোতে কতক্ষণ? সুতরাং, প্রতিবেশীকে ঈর্ষা করার আগে দুবার ভাবুন। আর এরপরেও যাঁরা সঞ্চয় করতে পারছেন, সত্যিই তাঁরা নমস্য ব্যক্তি।।