স্বরূপ গোস্বামী
ধরা যাক, বিরাট কোহলি এবং চেতেশ্বর পুজারা দুজনেই সেঞ্চুরি করলেন। দু’জনের অভিব্যক্তি ঠিক কেমন হবে? আকাশ–পাতাল তফাত। একজন লাফিয়ে, ব্যাট ঝাঁকিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেবেন তিনি বিরাট কিছু করে বসলেন। কখনও গ্যালারির দিকে চুমু ছুড়ে দেবেন। কখনও মাটিতে বসে পড়বেন। অন্যদিকে, পুজারা! ধীর, স্থির, শান্ত। বড়জোর হেলমেট খুলবেন, আলতো করে ব্যাট তুলবেন, মুখে স্মিত একটা হাঁসি। ব্যস, এই টুকুই।
ধরা যাক, যশপ্রীত বুমরা একটা উইকেট নিলেন। দারুণ কোনও ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন বিপক্ষের দারুণ কোনও ব্যাটসম্যানকে। একটা হাত উপরে তুলে ছুটে আসবেন। সতীর্থরা এসে জড়িয়ে ধরবেন। মানে, যেটুকু উচ্ছ্বাস না দেখালেই নয়, সেইটুকুই। কিন্তু বিরাট কোহলি হয়তো মিড অন বা কভার থেকে ছুটে এসে লাফিয়ে পড়তে পারেন। চিৎকার করবেন। ফিরে যাওয়া ব্যাটসম্যানের দিকে তাকিয়ে অঙ্গভঙ্গি করবেন। যিনি উইকেট পেলেন, তিনি শান্ত। অথচ, যত উচ্ছ্বাস বিরাটের। এ যেন মায়ের থেকে মাসির আনন্দ বেশি।
আসলে, বিরাট কোহলি এরকমই। অনেকে বলেন আগ্রাসী। অনেকে বলেন, দেখনদারি। নানা ভঙ্গিমার, নানা পোজের ছবির সমাহার। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় নিমেশে ভাইরালও হয়ে যায়। যাঁর ইনস্টাগ্রামে ২৭ কোটি, এক্স হ্যান্ডলে ৭ কোটি, ফেসবুকে ৫ কোটি ফলোয়ার, তাঁর ছবি ভাইরাল হবে না তো কার ছবি হবে? একটি ছবি পোস্ট করার জন্য তিনি ঠিক কত টাকা পান? নানা সময়ে নানা অঙ্ক ভেসে ওঠে। কেউ বলেন ৫ কোটি, কেউ বলেন তারও বেশি। সবজান্তা গুগল জেঠুও দ্বিধায়।
ব্যাট হাতে হয়তো লাগাতার ব্যর্থ, একটা সময়ে সাড়ে তিন বছর কোনও শতরান নেই, তাও তিনি তারকা। আবার যেই রান পাবেন, অমনি কোনও প্রাক্তনের উদ্দেশে খোঁচা দিতে ছাড়বেন না। প্রাক্তনদের পরামর্শকে বলে বসবেন ‘আউট সাইড নয়েজ’। যে ক্রিকেটের সঙ্গে ‘ভদ্রলোকের খেলা’ তকমা জড়িয়ে আছে, তা কোথায় যেন বারবার এসে ধাক্কা খায়।
আসলে, বিরাট কোহলি মানেই শিরোনাম। কিছু করলেও শিরোনাম, না করলেও শিরোনাম। প্রচারের বৃত্তে থাকাটা বেশ উপভোগই করে এসেছেন। নইলে, একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো বারবার এভাবে জন পরিসরে টেনে আনতেন না। অনেকে বলতেন, অনুষ্কার সঙ্গে বেড়াতে গেলেও সঙ্গে নিশ্চয় ক্যামেরাম্যান যায়। নইলে, পেছন থেকে ওই ছবিগুলো কে তোলে! ছবি থেকে উপার্জন যদি একটা তাগিদ নয়, তবে স্টারডম নিয়ে প্রতিনিয়ত ভেসে থাকাও একটা বড় তাগিদ।
এই একটা বিরাট কোহলি। কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠে অন্য একটা বিরাট কোহলিও আছেন। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে তাঁর আচরণ যেন আমূল পাল্টে গেছে। যে বিরাট কোহলি অহরহ ছবি পোস্ট করতেন, তিনি যেন কার্যত স্বেচ্ছা নির্বাসনে। আইপিএলের পর থেকে তাঁর কটা ছবি সামনে এসেছে? হাতে গোনা কয়েকটা। তাও সেগুলো তাঁর পোস্ট করা নয়, অন্যরা বাজারে ছেড়েছেন। আইপিএলের পর থেকেই তাঁর ঠিকানা লন্ডন। কিন্তু সেখানে তিনি কী করছেন? যুবরাজ সিংয়ের চ্যারিটি অনুষ্ঠানের ছবি সামনে এসেছিল। লর্ডসে একদিন প্র্যাকটিস করার ছবি সামনে এসেছিল। এর বাইরে? তিনি তো ঘরে বসে চুপচাপ মহাভারত পড়ার বা মেগা সিরিয়াল দেখার বান্দা নন। তাহলে ঠিক কী করছেন? নিশ্চয় জিম করছেন, প্র্যাকটিস করছেন। চার–পাঁচ বছর আগে হলে কয়েক হাজার ছবি ঘোরাফেরা করত। আপন নিয়মে সেগুলো ভাইরাল হত। কাগজে সেগুলোই ফলাও করে ছাপাও হত। সেই নিয়ে প্রতিবেদনও হত। কই, এখন তো হচ্ছে না।
দিগন্তজুড়ে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। তিনি আচমকাই টেস্ট থেকে অবসর নিলেন। কিন্তু ইনস্টাগ্রামের একটা বিবৃতি ছাড়া আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই। নিশ্চিতভাবে এই অবসর নেওয়া পথটা খুব মসৃণ ছিল না। যে কোহলি এত হুল্লোড়প্রবণ, এত গ্যালারি শো করতে ভালাবাসেন, তিনি সবার আড়ালে কয়েক লাইন ইনস্টাগ্রাম পোস্ট লিখে অবসর নিলেন? সেখানেও কোনও খোঁচা নেই, অভিমান নেই, ক্ষোভ নেই। আগ্রাসী কোহলি হঠাৎ এমন ‘দার্শনিক’ হয়ে উঠলেন কীভাবে? দুই ঘরানায় অবসরের পর তিনি শুধুমাত্র ৫০ ওভারের ক্রিকেটে। সত্যিই কি দু’বছর পরের বিশ্বকাপে খেলবেন নাকি এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরেই ‘গুডবাই’ জানাবেন? যত জল্পনাই ভেসে বেড়াক, দল নির্বাচনের পরেও তিনি কিন্তু স্পিকটি নট।
তাঁর এত এত ভক্তকূল। ইংল্যান্ড সফরের আগেই তিনি এমনভাবে অপমানিত হয়ে সরে দাঁড়ানোর পর তাঁরা কোথায়? অবসর ভেঙে আবার ফিরে আসতে হবে, এমন আওয়াজ তো সেভাবে উঠে এল না। বিরাট কোহলির মতো মহাতারকার বিদায় কি আরও বর্ণময় হতে পারত না? বিরাট–রোহিতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গৌতম গম্ভীররা এমন ছিনিমিনি খেলার সাহস পাচ্ছেন কোত্থেকে? এই ভক্তকূল ইনস্টাগ্রামে লাইক দিতে পারেন, সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নামতে পারেন না। কোহলি নিজেও বুঝেছেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, ভক্তকূল ফেসবুকে।
আসলে, সেই কোহলি আর এই কোহলির অনেক ফারাক। সেই কোহলি খুঁজতেন স্পটলাইট। আর এই কোহলি বোঝেন অন্তরাল। দীর্ঘ চড়াই–উতরাই তাঁকে শিখিয়েছে, জীবনে আড়ালটাও কখনও কখনও খুব জরুরি।
