ভাইপো নয়, এবার ‘‌ভাগ্নে’‌ বলতে শিখুন

রক্তিম মিত্র

সালটা ২০২২। তখন ডিসেম্বর মাস। ইংরাজি বছর শেষ হয়ে নতুন বছর আসার কথা। শুভেন্দু অধিকারী হুঙ্কার দিয়ে বসলেন, ডিসেম্বরেই বড় ধামাকা। কী সেই ধামাকা?‌ সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতটা ছিল পরিষ্কার, এবার বড় মাথা ধরা পড়তে চলেছে।

দিন যায়, মাস যায়। দেখা গেল, কার্যত কিছুই হল না। পর্বতের মূষিক প্রসব বলতে যা বোঝায়, সেটুকুও নয়। নাকের বদলে নরুনও নয়। ‌ডিসেম্বর থেকে ধামাকা সিফ্‌ট হয়ে গেল জানুয়ারিতে। জানুয়ারিতে কিছু একটা হবে। জানুয়ারি গড়িয়ে গেল ফেব্রুয়ারিতে। এভাবেই এসে গেল মার্চ–‌এপ্রিল। তখনই সার কথাটা জানিয়ে ছিলেন তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সিবিআই–‌ইডিকে চড়া ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, আপনারা দুর্নীতির মাথা তো দূরের কথা, কোমর পর্যন্তও পৌঁছতে পারেননি। দু একটা খুচরো এজেন্ট ধরে ভেবে নিচ্ছেন, অনেক কিছু করেছি। টাকা কার কাছে পৌঁছত, তা নিয়ে কিছুই করতে পারেননি।

বিচারপতি অমৃতা সিনহাও হেঁটেছিলেন সেই একই রাস্তায়। তিনি ইডি কর্তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তদন্তের নামে কিছুই হয়নি। আপনারা হয়তো আসল অপরাধীকে আড়াল করতে চাইছেন। আপনারা নিজেরাই তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে সাহায্য করছেন। হ্যাঁ, এই ভর্ৎসনাটাই সিবিআই বা ইডি–‌র প্রাপ্য। আরও ভাল করে বলতে গেলে, যাঁরা সিবিআই বা ইডিকে চালান, তাঁদের প্রাপ্য।

বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বকে দেখে কিছুটা করুণাই হয়। তাঁরা আন্তরিকভাবেই চান, সিবিআই জোরদার তদন্ত করুক। একে–‌তাকে জেলে ভরুক। তাহলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু দিল্লির কাছে তাঁরা যে নেহাতই ছাগলের তৃতীয় সন্তান, এটুকু তাঁরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না। সবার সন্দেহের তীর যাঁর দিকে, তিনি এখনও কী অবলীলায় হুঙ্কার ঝেড়ে চলেছেন। কখনও বলছেন, সিবিআই–‌ইডি আমার কাঁচকলা করবে। কখনও বলছেন, আমার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ দেখিয়ে দিন। কখনও বলছেন, ধর্নায় দিল্লি অচল করে দেব। কখনও গণনাকেন্দ্র থেকে খোদ বিজেপি প্রার্থীকেই সকাল আটটায় মারধর করে বের করে দেওয়া হয়।

মাঝে মাঝেই প্রশ্ন ওঠে, এই স্পর্ধা আসে কোত্থেকে?‌ হয় সততা থেকে, নইলে উচ্চস্তরের বোঝাপড়া থেকে। প্রথমটা তাঁর সম্পর্কে একেবারেই খাটে না। তিনি সৎ, একথা শুনলে তৃণমূলের লোক সবথেকে বেশি হাসবে। খোদ তৃণমূলে এমন একজনকে পাওয়া যাবে না, যিনি মনে করেন এই মানুষটি সৎ। কোনও ব্যোমকেশ–‌ফেলুদার দরকার নেই। কোনও সিবিআই–‌ইডিরও দরকার নেই। সাদা চোখে যা দেখা যায়, সেটাই যথেষ্ট। তিনি পাকা খেলোয়াড়, তাঁকে বুদ্ধি দেওয়ার ধুরন্ধর সব মাথা আছে, এটাও ঠিক। বড় বড় আমলা আছেন তাঁকে সুরক্ষা দিতে, বড় বড় অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছেন, দুর্নীতিকে আরও মসৃণ পথে পরিচালনার জন্য। কিন্তু তারপরেও অনেক ফাঁক থেকে গেছে। যা একেবারে সাদা চোখেই নগ্নভাবে ধরা পড়ে। তাঁর ঘোষিত সাগরেদদের কাণ্ড কারখানা দেখেই বোঝা যায়, নাটের গুরুটি কেমন হতে পারেন।

কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান। তিনি গলা উঁচু করে হুঙ্কার ঝেড়ে যান। কারণ, তিনি জানেন, রাখে হরি মারে কে!‌ এই হরিটা কে বলুন তো!‌ রাজ্যের পুলিশ বা প্রশাসন কার্যত তাঁর ভৃত্যসম। ফলে, তাঁদেরকে ঘিরে কোনও আশঙ্কা না থাকারই কথা। কিন্তু যাঁদের ঘিরে আশঙ্কা থাকার কথা, তাঁদের ঘিরেও আশঙ্কা নেই। কারণ, জানেন, তাঁদের টিঁকিটা কোথায় বাঁধা। মাথায় কার স্নেহের হাত, কার প্রশ্রয়ের হাত রয়েছে, শুভেন্দু অ্যান্ড কোং কি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না!

বলা হল, এবার তাঁর বিরুদ্ধে জবরদস্ত প্রার্থী দেওয়া হবে। প্রায় দু’‌মাস ঝুলিয়ে রাখা হল। তারপর যে প্রার্থী দেওয়া হল, তাকে পর্বতের মূষিকপ্রসব বললেও বোধ হয় একটু বেশি বলা হয়। মূষিক নয়, পিপড়ে প্রসব বলা যায়। এটা যদি ওয়াকওভার না হয়, তাহলে ওয়াকওভার আর কাকে বলে‌!‌ জানাই ছিল, খোকাবাবুর ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী, নির্বাচন কমিশন— সবই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই থাকবে। ঠিক তাই থাকল। এমনকী, গণনার দিন বিজেপি প্রার্থী ও এজেন্টেদের সকাল আটটার মধ্যে গণনা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হল। কোথায় সিসি টিভি?‌ কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী?‌ কোথায় নির্বাচন কমিশন?‌

তাই আর তাঁকে ভাইপো ভাইপো বলে ডাকার কোনও মানে হয় না। ভাইপো হয়ে রাজ্যের গন্ডিতে সুরক্ষিত থাকা যায়, মাতব্বরি করা যায়। কিন্তু ‘‌ভাইপো’‌ তকমাটা সিবিআইয়ের কাছে বাঁচার জন্য যথেষ্ট নয়। সেখানে আরও প্রভাবশালী কারও ‘‌ভাগ্নে’‌ হতে হয়। কাজেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁকে মোদির ‘‌ভাগ্নে’‌ বলা যায় কিনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভেবে দেখতে পারেন।

বামেরাও ভেবে দেখতে পারেন। ‘‌সেটিং’‌ শব্দটা বড্ড পুরনো হয়ে গেছে। এবার ‘‌ভাগ্নে’‌ শব্দটাকে বাজারে আনা যায় কিনা ভেবে দেখুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *