অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়
অনীক দত্তর প্রতি আমার একটা বাড়তি দুর্বলতা আছে। সেটা সেই ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ থেকে। একেবারে অন্য ঘরানার এক ছবি। কিন্তু পরের ছবিটা, অর্থাৎ ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ তেমন ভাল লাগেনি। এবার বানালেন ‘ভবিষ্যতের ভূত’। ছবিটা প্রচার পেল বিস্তর। কিন্তু হল পেল না। আসলে, তার আগেই চাকে ঢিল মেরে ফেলেছিলেন পরিচালক। ফিল্ম ফেস্টিভালে নন্দনজুড়ে শুধু একটি মুখের এত বিজ্ঞাপন কেন, এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! কোন হলমালিকের ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে, তাঁর ছবি চালাবে? ছবিতে হাততালি পাওয়া সংলাপ ছিল। বিস্তর বিতর্কও ছিল। কিন্তু ছবি হিসেবে মোটেই সেই মানের হয়নি।
যাই হোক, এবার বরুণবাবুর বন্ধু। তারপর সবশেষে নিজেকে উজাড় করে দিলেন ‘অপরাজিত’ ছবিতে। শতবর্ষে সত্যজিৎকে তুলে আনলেন একেবারে অন্য আঙ্গিকে। পথের পাঁচালী তৈরির নেপথ্য কাহিনি দারুণভাবে তুলে আনলেন সেলুলয়েডে। এত এত গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ যা করতে পারেনি, একটি ছবি যেন সেই কাজটাই করে দিল। শুধু বিতর্ক তৈরি নয়, শুধু চটকদার রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া নয়, অনীক দত্ত ছবি করতে জানেন।
তাঁর ছবিতে বড় মাপের তারকা থাকে না। বিরাট বাজেট থাকে না। জমকালো প্রচার থাকে না। বিরাজ বাণিজ্যিক সাফল্যও থাকে না। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু দর্শক আছেন। আমি সেই তালিকাতেই পড়ি। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এবার পুজোয় তাঁর ছবিটাই আগে দেখব।
একদিকে প্রসেনজিতের ‘দেবী চৌধুরানী’, অন্যদিকে দেবের ‘রঘু ডাকাত’, শিবপ্রসাদ–নন্দিতা জুটির ‘রক্তবীজ ২’। ধারেভারে এই ছবিগুলো অনেক এগিয়ে। সেই তুলনায় ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’ কিছুই নয়। ওই তিন ছবির যা বাজেট, যা প্রচারের ঢক্কানিনাদ, সেই তুলনায় অনীক দত্তর এই ছবি অনেক পিছিয়ে। অনেকটা যেন ছাগলের তৃতীয় ছানার মতোই। প্রথমে এই ছবি দেখেছি। পরে বাকি দুটো ছবিও দেখেছি। বলতে দ্বিধা নেই, এবার পুজোয় সেরা ছবি উপহার দিয়েছেন অনীক দত্তই।
এটাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই সত্যজিৎ রায়কেই শ্রদ্ধার্ঘ্য। ফেলুদা নয়, এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র তোপসে। ফেলুদা বা জটায়ু না থাকলেও ঘুরেফিরে তাঁদের প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন এসেছে ফেলুদা সিরিজের বিভিন্ন কাহিনি ও উপন্যাসের কথা। গোয়েন্দাগিরি আছে, তবে অহেতুক মারামারি বা বীরত্ব দেখানো নয়। বরং বুদ্ধির ছাপ অনেক বেশি। আবীরের চোখেমুখে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার আছে। একটা ইতিহাস চেতনাও আছে। ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’র আদলে ছবির নাম ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন, ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’। সত্যিই, এই কলকাতাকে আমরা কতটুকুই বা চিনতাম? আমরা কজন জোব চার্নকের সমাধিস্থলে গেছি? বাংলাদেশ থেকে নিজের পূর্বপুরুষকে খুঁজতে আসা এক তরুণীর চোখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা মাখানো সেই কলকাতা। চেনা কলকাতা ধরা দিল কত অচেনা আঙ্গিকে। এরই মাঝে একপ্রস্থ পাহাড় ভ্রমণ। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া দার্জিলিং, কার্শিয়াং। আহা, রহস্যের ফাঁকে পুজোর আমেজে মানসভ্রমণও হয়ে গেল।
এখানে তারকার ভিড় নেই, আইটেম সংয়ের বাহুল্য নেই, অকারণ থ্রিলার নেই। যা আছে, তা ধাঁধা। মগজাস্ত্রে শান। রহস্যের ফাঁকেই ইতিহাসের সরণি বেয়ে একটু পায়চারি। প্রতিটি দৃশ্যই যেন যত্ন নিয়ে বানানো। সবমিলিয়ে মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতোই।
ছবির আগে একটা অহেতুক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। আবীর ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকলেও এই ছবির প্রচারে ছিলেন না। কারণ, পুজোয় তাঁর অন্য একটি ছবিও (রক্তবীজ ২) মুক্তি পেয়েছে। তিনি নাকি সেই প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন, অন্য কোনও ছবির প্রচার করবেন না। সত্যিই, বাণিজ্যিক রেশারেশি কোন স্তরে যেতে পারে! এইটুকু বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। তার ভেতর এত আঁকচা–আঁকচি! ঘটনাচক্রে ‘রক্তবীজ ২’ ছবিটাও দেখেছি। সেই পরিচালক জুটির সব ছবিই দেখেছি। তাঁদের প্রতিও আমি যথেষ্টই শ্রদ্ধাশীল। তারপরও বলছি, অন্তত আমার রুচি অনুযায়ী, গুণগত মানের বিচারে এই ছবি অনেক এগিয়ে। বছর দশেক পরে, আবীরকে যদি তাঁর সেরা ছবির তালিকা বানাতে বলা হয়, তিনিও অন্তত রক্তবীজের থেকে এই ছবিকে অনেক এগিয়ে রাখবেন।
