অশ্বডিম্ব প্রসব করবে এসআইআর, গোবধের উল্লাস করবে অবোধ বঙ্গ–‌বিজেপি

রক্তিম মিত্র

গত কয়েক মাস ধরে একটা কথাই ঘুরেফিরে ভেসে আসছে, এসআইআর। পাড়ায় পাড়ায় বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে, যেন এসআইআর হলেই বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসবে। আর এই এসআইআর নিয়ে গলা চড়াতে গিয়ে তাঁরা যা যা যুক্তি তুলে ধরছেন, তাতে নিজেদের ব্যর্থতাই আরও বেশি করে প্রকট হচ্ছে।

যেমন, আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তিনি মাঝে মাঝেই হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, ‘‌গত দশ বছরে এই বাংলায় এক কোটি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের এবার তাড়ানো হবে।’‌ হাততালি পাচ্ছেন ব্যাপক। কারণ, যাঁরা হাততালি দিচ্ছেন, তাঁদের এত বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই।

আচ্ছা, ধরেই নিলাম, দশ বছরে এক কোটি লোক এই বাংলায় ঢুকেছেন। যদি সত্যিই ঢুকে থাকেন, তাহলে কার কান ধরে উঠ–‌বস করার কথা। দেশের সীমান্ত কারা পাহারা দেয়?‌ সেই দপ্তরের মন্ত্রী কে?‌ মোদি সরকারের প্রথম পাঁচবছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ছিল রাজনাথ সিং, পরের পাঁচ বছর অমিত শাহ। বিরোধী দলনেতার দাবি সত্যি হলে, এই দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থ। তার মানে, এই দুজনকে কি চরম অপদার্থ বলতে চাইলেন?‌

ধরেই নিলাম, এঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড পেতে রাজ্য প্রশাসনের অনেকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এঁরা যদি সীমান্ত পেরিয়ে না আসতেন, তাহলে তো তাঁদের ভোটার কার্ড বানিয়ে দেওয়ার সুযোগটাই থাকত না। অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন, রাজ্যে অনেক জায়গায় কাঁটাতার দেওয়া নেই, তাই অনুপ্রবেশ হচ্ছে। এটা তাঁরাই বলতে পারেন, সীমান্ত সম্পর্কে যাঁদের তেমন কোনও ধারণা নেই। একবার টাকি থেকে ঘুরে আসুন। একবার যে কোনও সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘুরে আসুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন। অসমেও তো বিরাট এলাকা কাঁটাতার নেই। অরুণাচলেও সীমান্ত নেই। আরও অনেক রাজ্য রয়েছে, যেখানে কাঁটাতার নেই। কেন্দ্র আগে সেইসব রাজ্যে কাঁটাতারের ব্যবস্থা করুক। তারপর না হয় বাংলা নিয়ে জ্ঞান দেবে।

হ্যাঁ, সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ যেমন হয়, তেমনই গরুপাচার হয়। আরও অনেককিছুই পাচার হয়। রাজ্য পুলিশের বড় একটা অংশ যেমন এতে যুক্ত থাকে, ঠিক তেমনই কেন্দ্রীয় এজেন্সির কারও কারও সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই পাচার সম্ভব নয়। সেই পাচারের বখরা যেমন রাজ্যের কোনও কোনও ‘‌প্রভাবশালী’‌র কাছে যায়, ঠিক তেমনই কেন্দ্রের কিছু কিছু মাতব্বরের দরবারেও যায়। সেই কারণেই সিবিআই নামক আপাদমস্তক অপদার্থ সংস্থাটি বছরের পর বছর হাত গুটিয়ে বসে থাকে। অনুপ্রবেশের মূল দায় যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, ঠিক তেমনই গরু পাচার থেকে শুরু করে রাজ্যের নানা তদন্তে সিবিআই–‌এর ঘুমিয়ে থাকার দায়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

আসল কথা হল, প্রতিবার ভোটের আগে তাঁদের কিছু না কিছু আতঙ্ক ছড়াতে হয়। কখনও এনআরসি, কখনও সিএএ। আর এরকম ইস্যু পেয়ে গেলে তৃণমূলেরও পোয়াবারো। একজন কেন্দ্র চালায়, একজন রাজ্য চালায়। কারও কোনও জবাব দেওয়ার দায় নেই। একজন হিন্দু হিন্দু করে বেড়ান, অন্যজন সেই সুযোগে মুসলিম তাস খেলেন। ২০১৯ থেকে এনআরসি নিয়ে ভয় দেখানোর কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের রাজ্যে কেন্দ্র কতটুকু এগোতে পেরেছে?‌ এত ঘটা করে সিএএ চালু হল। এই বাংলায় কজন আবেদন করেছেন?‌ শান্তনু ঠাকুর বিজেপির সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁকে একবার আবেদন করতে বলুন তো। অর্থাৎ, মোদি–‌অমিত শাহর সিএএ নীতির ওপর তাঁর সরকারের মন্ত্রীরই আস্থা নেই। বেশি জোরাজুরি করলে বাবুল সুপ্রিয়র মতো তিনিও সটান তৃণমূলে চলে আসবেন।

আসলে, দুই সরকারকেই মৌলিক প্রশ্ন থেকে পালিয়ে বেড়াতে হবে। তাই কখনও এনআরসি জুজু, আর কখনও এসআইআর জুজু। আর এমন ইস্যু পেয়ে গেলে তৃণমূলের তো মুশকিল আসান। তারা এই নিয়েই বাজার গরম করে যাবে। তখন বেকারত্ব, দুর্নীতি, পাচার, গোষ্ঠীকোন্দল— এসব ইস্যু অনেক তলানিতে চলে যাবে। আসরে নামানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। সারা বছর এই সংস্থাটি কোথায় যে থাকে, কী যে তার কাজ, বোঝাই মুশকিল। ভোট এলেই হঠাৎ করে উদয় হয়, ফাঁপা আওয়াজ দেওয়া শুরু হয়ে যায়।

আচ্ছা, মৃত ভোটারদের নাম হয়তো বাদ যাবে। এতে এত হুম্বিতুম্বির কী আছে?‌ এতদিন সেই নাম বাদ যায়নি কেন?‌ এটা তো রুটিন পদ্ধতি। তার পরেও বছরের পর বছর সেইসব মৃত ভোটারের নাম থেকে গেছে, কারণ নির্বাচন কমিশন তার রুটিন কাজটুকুও করেনি। যে কেউ মারা গেলে পঞ্চায়েত বা পুরসভা থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হয়। অর্থাৎ, তাদের কাছে তালিকা থাকার কথা। সেই তালিকা প্রতিমাসে তারা জেলা প্রশাসনকে পাঠাবে। জেলা প্রশাসন সরাসরি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেবে। এই আধুনিক প্রযুক্তি আর ডিজিটাল ইন্ডিয়ার যুগে এটা কোনও কঠিন কাজ?‌ কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এই ন্যূনতম মেশিনারিটুকুও নেই। তাঁদের হুমকিকে কে পাত্তা দেয়?‌

এ রাজ্যের তৃণমূল খুব ভাল করেই জানে, ভোট এলে এই নখদন্তহীন কমিশন বড়জোর দু–‌একজন অফিসারকে ট্রান্সফার করবে। এর বেশি কিচ্ছু করার মুরোদ এই কমিশনের নেই। লোকসভার গণনা কেন্দ্র থেকে সকাল আটটার মধ্যে বিরোধীদের সব এজেন্ট, এমনকী প্রার্থীকেও মেরে বের করে দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তরা এই সাহস পায়, কারণ তারা জানে, নির্বাচন কমিশন কিচ্ছু করতে পারবে না। বছরের পর বছর, নির্বাচন কমিশন নিজেদের এতটাই হাসির খোরাক করে তুলেছে। সত্যিই, তাদের সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।

তাই যতই এসআইআর হোক, দিনের শেষে তা পর্বতের মূষিক প্রসবই হবে। ঠিক সিবিআই তদন্তের যে হাল হয়েছে, এসআইআরেও তাই হবে। কিছু মৃত ভোটারের নাম বাদ পড়বে, এতেই বঙ্গ বিজেপি উল্লাস দেখাবে। অবোধের গো বধেই আনন্দ।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *