ড. অন্তরা চৌধুরি
বাংলা সাহিত্যে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে আমরা যাঁদের বুঝি, তাঁদের মধ্যে তারাশঙ্কর এলেন নবীন–প্রবীণের দ্বন্দ্ব এবং অতীত ও বর্তমানের একটা যোগসূত্র নিয়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখালেন মানুষের মনের বিচিত্র জটিল রূপকে। সেখানে বিভূতিভূষণের সাহিত্যে আমরা পেলাম প্রকৃতি, মানুষ ও ঈশ্বরের মিলিত রূপকে। বিভূতিভূষণের প্রতিটি গল্প, উপন্যাসের কেন্দ্রেই রয়েছে মানুষ। সেই মানুষকে আশ্রয় করেই কখনও প্রকৃতি, কখনও ঈশ্বর, কখনও বা জীবনের বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গল্পের চরিত্ররা প্রত্যেকেই গ্রামীণ সমাজের নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষ, যাঁদের মধ্যে শহুরে আদব–কায়দা বা নাগরিক আভিজাত্য নেই। তাঁদের সেই ছোট ছোট সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা এবং গোপন দুঃখ স্থান পেয়েছে বিভূতিভূষণের সাহিত্যে। বিভূতিভূষণের সাহিত্যে নিসর্গ যেমনভাবে আমাদের মুগ্ধ করে, তেমনভাবেই মুগ্ধ করে মানুষ। আলোর কাছে কালোর মতো। তাই প্রকৃতি বিভূতিভূষণের সাহিত্যের বিশেষ উপাদান হলেও প্রধান উপাদান নয়। প্রধান উপাদান কিন্তু পল্লী বাংলার সেই সাধারণ মানুষ, যারা অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে।
‘পথের পাঁচালী’তে অপুর হাত ধরে আমাদের পথ চলা শুরু হয়েছিল। তার চোখ দিয়ে আমরা যখন প্রকৃতিকে দেখি, তখন তার সেই ছোট ছোট ভাল লাগা, মুগ্ধতা, বিস্ময় কোথাও যেন আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। নিশ্চিন্দিপুরে আমরা ফিরে পাই আমাদের শৈশবকে। সামান্য জিনিসকে অসামান্য করে দেখানো এবং খুব তুচ্ছ উপাদানেও যে পরম আনন্দ পাওয়া যায়, সেটা আমরা বিভূতিভূষণের সাহিত্যে পেয়েছি। তাই যে কারণে আমাদের বারবার ফিরতে হয় বিভূতিভূষণের কাছে, তা হল, তাঁর সমগ্র সাহিত্য জুড়ে রয়েছে এক প্রবল অস্তিবাদ। আনন্দের মধ্যে দুঃখ (‘তালনবমী’) এবং দুঃখের মধ্যেও যে আনন্দের ঐশ্বর্য থাকে (‘মেঘমল্লার’), চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও দরিদ্র না হওয়া (‘পুঁইমাচা’), ঘেঁটু ফুলকেও যে মহার্ঘ্য করে দেখানো যেতে পারে, এবং খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপাদানেও যে জীবনের পরম আনন্দ পাওয়া যায়, সেটা আমরা বিভূতিভূষণের সাহিত্যে পেয়েছি। তাই বিভূতিভূষণের সাহিত্য আমাদের কাছে বেঁচে থাকার বিশল্যকরণী।
এছাড়া, প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের অনুভূতির প্রকাশ আমরা তাঁর সাহিত্যে পেয়েছি। ছোট গল্প সৃজ্যমান সাহিত্যের সংরূপ হওয়ায় তার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বিভূতিভূষণও তাঁর গল্পকে কোনও নির্দিষ্ট ফর্মে বাঁধেননি। তাই তাঁর কোনও কোনও গল্পে গল্পটাই নেই। অর্থাৎ না–গল্প বা অ্যান্টি স্টোরির একটা প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে তিনি গল্পটা বলবেন কিনা, সেই ভাবনাটাকে নিয়েই নাড়াচাড়া করছেন গল্পের প্রধান চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে। যেমন, ‘বাইশ বছর’ বা ‘মণি ডাক্তার’ নামক গল্প।
এছাড়া, তাঁর গল্পে একটা রহস্যময়তা এবং অলৌকিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর গল্পে যুক্তি যেমন আছে, তেমনই যুক্তিহীনতাও আছে। সাধারণ সংস্কার, অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক ঘটনা, রহস্যময়তাও তাঁর গল্পে পাওয়া যায়। সংস্কারের জাল ছিন্ন করার সাহস যেমন আছে, তেমনই সাময়িক দুর্বলতাকে আশ্রয় করার দৃষ্টান্তও আছে। যেমন, ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’, ‘খুঁটিদেবতা’। জীবনকে দেখাতে গিয়ে তিনি কোনও তত্ত্বকথার আশ্রয় নেন না। কোনও আরোপিত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণেও যান না। ঠিক যেমনটি তাঁর চোখে ফুটে উঠেছে, সেভাবেই জীবন ফুটে ওঠে তাঁর কলমে।
বাংলাদেশে সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী। তাদের দুঃখ, দারিদ্র্যময় জীবন, আশা–নিরাশা, হাসি–কান্না, বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্র জগৎগুলির ঘাত–প্রতিঘাত, বাংলার ঋতুচক্র, বাংলার সন্ধ্যা–সকাল, আকাশ–বাতাস, ফল–ফুল, বাঁশবাগান এবং আমবাগানের নিভৃত যাপন, ছায়াঝরা সজনে ফুল বিছোনো পথের ধারে যে জীবন সকলের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথা এবং তাদের গোপন দুঃখকে রূপ দিতে চেয়েছেন বিভূতিভূষণ তাঁর গল্পে।
বেশ কিছু গল্পে সময়ের একটা ব্যপ্ত পটভূমি লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ, গল্পটা যে সময়ে শুরু হচ্ছে, তার থেকে বেশ কয়েক বছর পরে গিয়ে গল্পটা শেষ হচ্ছে। অর্থাৎ, ছোট গল্পের যে প্রধান বৈশিষ্ট, সংহতি এবং একমুখীনতা, সেটা অনেকক্ষেত্রে রক্ষিত হচ্ছে না। এটাও তাঁর গল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
মৃত্যুতে গল্পের পরিসমাপ্তি— বিভূতিভূষণের গল্পের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর বিশেষত্ব হল, মৃত্যুতেই গল্পের শেষ মূল্যায়ন হয় না। তাঁর গল্পগুলি জীবন রসের গল্প। যেমন, ‘পুঁইমাচা’ নামক গল্পটি।
‘পুঁইমাচা’ এক উপেক্ষিত নারীর গল্প। ‘পথের পাঁচালী’র পূর্বসূরি ‘পুঁইমাচা’ গল্পে গ্রাম বাংলার প্রেক্ষাপটে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন সহায়হরি চাটুজ্জে ও তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণার দুঃখময় জীবনের কাহিনি। তাঁদের তিনটি কন্যা। ক্ষেন্তি, রাধী ও পুঁটি। বিবাহযোগ্যা কন্যা ক্ষেন্তিকে নিয়েই এই গল্পটি কয়েকটি বৃত্তে আবর্তিত হয়েছে। ক্ষেন্তি যেন ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গার পূর্বসূরি। গ্রামের মেয়ের মতোই তার চেহারা। সে শুধু একটু খেতে ভালবাসে। পুঁই শাকের ওপর এই মেয়েটির বড্ড লোভ। সেটা তার মা অন্নপূর্ণা ভালই জানেন। তাই ক্ষেন্তির আনা বুড়ো পুঁইশাক প্রথমে ফেলে দিলেও পরে সকলের আড়ালে তার মা রান্না করেছেন। গল্পের মধ্যে ক্ষেন্তি চরিত্রটির প্রথম প্রবেশও ঘটেছে পুঁইশাক হাতে। অসময়ে আগাছা তুলে আনার জন্য মায়ের কাছে ক্ষেন্তিকে যথেষ্ট অপদস্থ হতে হলেও ক্ষেন্তির প্রতি অন্নপূর্ণার বাৎসল্যের পরিচয় ফুটে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন সমাজব্যবস্থার একটা রূপ চোখে পড়ে এই গল্পে। কন্যা দায়গ্রস্থ অসহায় বাবা–মায়ের একটা সামাজিক অস্তিত্বের সংকট লক্ষ্য করা যায়। তৃতীয়ত, চঞ্চলা, সরল বালিকা ক্ষেন্তিকে দারিদ্র্য ও সামাজিকতার চাপে মাঝবয়সী দোজবোরের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন তার বাবা–মা। পণপ্রথার সামাজিক বলি হয়ে ওঠে ক্ষেন্তি। বিয়ের মাত্র এক বছরের মধ্যেই অযত্নে, অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় ক্ষেন্তির মৃত্যু হয়। ক্ষেন্তি ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গার মতোই প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এক মেয়ে। তার প্রিয় পুঁইশাকের মতোই সজীব ও শ্যামল। তবে স্বভাবে দুর্গার তুলনায় একটু বেশিই নিরীহ।
ক্ষেন্তির মৃত্যু বিভূতিভূষণের সাহিত্যে একটি পরিচিত কৌশল। কিন্তু ‘পুঁইমাচা’ জীবন রসের গল্প। ক্ষেন্তির মৃত্যুতেই গল্পের শেষ হয় না। ‘প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর’— এই শেষ বাক্যটিতে গল্পটি মৃত্যুকে ডিঙিয়ে আবার জীবনের কাছে ফিরে যায়। ‘প্রবর্ধমান’ আর ‘প্রবহমান’ এখানে এক হয়ে যায়। মাচার ওপর একটা পুঁই লতা তুলে দিয়েই তিনি যা বলার, সব বলে দিলেন। এ জন্যই তিনি মহৎ গল্প লেখক। পুঁইমাচার ক্ষেন্তিও যেন মৃত্যুর পর তার নিজের হাতে লাগানো নধর, সুপুষ্ট পুঁই লতার মধ্যে যেন অনন্ত জীবন স্বরূপে ব্যপ্ত হয়েছে। পুঁই গাছ হয়ে উঠেছে ক্ষেন্তির অভিজ্ঞান।
‘বিপদ’ গল্পে হাজু পেটের দায়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে শহরে নটী হয়। একদিন লেখককে ‘জ্যাঠামশাই’ বলে ডেকে নিজের বৈভব দেখায়। তার সরলতার কাছে ম্লান হয়ে যায় বেশ্যাবৃত্তির কলঙ্ক। এমন গল্প সত্যিই দুর্লভ। কারণ, তারাশঙ্করের লেখায় আমরা ঊর্বশী সুলভ ছলাকলার পরিচয় পেয়েছি। যেমন, ‘বেদেনী’, ‘যাদুকরী’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় পতিতাবৃত্তির তিক্ততা, বিপণ্ণতা, অসহায়তা দেখেছি। যেমন, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’। কিন্তু বিভূতিভূষণের পতিতারা যেন ঘরের আদুরী মেয়ে। পেশাগত কোনও পঙ্কিলতা তাদের স্পর্শ করেনি।
বিভূতিভূষণ ‘ডাকগাড়ি’ বলে একটা গল্প লিখেছেন। সেখানে রাধা নামের একটা মেয়ে অকাল বিধবা। বাপের বাড়িতেই থাকে। তার একটুও ভাল লাগে না। বাপ–মা সবসময় ঝগড়া করে। তার সামনে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সে গ্রামেরই একটা মেয়ের সঙ্গে মিশতে চায়। কিন্তু মেয়েটা তাকে পাত্তা দেয় না। একদিন কোথাও একটা যাওয়া হবে বলে সে জোর করে তার ভাইয়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠে পড়ে। গন্তব্য শ্বশুরবাড়ি। কারণ, সেখানে তার ছয় ভরির একটা হার রয়েছে। কিন্তু শাশুড়ি, ননদ তাকে আনতে দেয় না। গঞ্জনা দেয়। এমন সময় দার্জিলিং মেল ঝমঝম করে রানাঘাট স্টেশনে ঢুকে পড়ে। সেই ট্রেনের ভেতরটা দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এমন ঝকঝকে, তকতকে ভেতরটা। ভেতরে খাবার আলাদা কামরা রয়েছে। সাহেব, মেম বসে রয়েছে। তার মনে হয় মাত্র ছ’পয়সা খরচ করলেই সে এই ট্রেন দেখতে পাবে। দার্জিলিং মেল যেন উদ্দীপনাময় একটা কবিতা।
তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় গল্প ‘ভন্ডুল মামার বাড়ি’। গল্পের ক্যানভাসটা অনেক বড়। অনেকটা লম্বা পরিসর নিয়ে তার বিস্তার। ভন্ডুল মামা একটি চরিত্র, বেশ সরল। সে কাজের সূত্রে বাইরে থাকে। কিন্তু তার স্বপ্ন, একদিন সে পাকা বাড়ি তৈরি করে গ্রামে ফিরবে। লেখক ছোটবেলায় বারবার মামাবাড়ি যায়, দিদার কাছে ভন্ডুলমামার গল্প শোনে। কিন্তু এই ভন্ডুল মামাটি কে, তা আর দেখা হয়নি। অথচ সে শুনে আসছে, ভন্ডুল মামা বাড়ি করছে, এখানে এসেই থাকবে। বাড়ির গাঁথনি হয়, বছরের পর বছর ওই অবস্থাতেই পড়ে থাকে। কয়েক বছর পর হাতে টাকা এলে আরও কিছুটা কাজ এগোয়। কিন্তু আবার বন্ধ হয়ে যায়। ভন্ডুল মামা রিটায়ার করার পর গ্রামে ফিরতে চায়। বউ–ছেলেরাও গ্রামে ফিরুক, এটাই চায়। সারা জীবন ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে শেষজীবনে অন্তত নিজের বাড়িতে থাকার তৃপ্তি চায়। কিন্তু ভন্ডুলমামা চাইলে তো হবে না। তার স্ত্রীও গ্রামে আসতে চায় না, ছেলেও চায় না। অগত্যা, ছুটিছাটা পেলে ভন্ডুল একাই চলে আসে। জঙ্গল সাফ করে। এটা–সেটা কাজ করে। বাড়ি আর তৈরি হয় না। কিন্তু এই স্বপ্নকে আজীবন লালন পালন করতে থাকে। রিটায়ারের পর ভন্ডুল সত্যিই গ্রামে ফিরল, কিন্তু পরিবারের অন্য কেউ ফিরল না। অন্যদের কাছে এই নস্টালজিয়ার, এই শিকড়ের কাছে ফেরার কোনও মূল্য নেই। সবাই যখন বৈষয়িক, তাদের কাছে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ির জন্য এমন মায়ার যুক্তিও নেই। তাদের কাছে ভন্ডুল নিতান্তই বোকা লোক। কিন্তু ভন্ডুল তার বোকামিতেই দিব্যি খুশি। সে তিল তিল করে স্বপ্নকে লালন করাতেই খুশি। এভাবেই সবার অলক্ষ্যে একদিন সেই বাড়িতেই তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। লেখক নিজেই শেষবেলায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘অমন একটা সাধারণ জিনিস কেন আমার মনে এমন জুড়ে বসে রইল, অথচ কত বড় বড় ঘটনা তো বেমালুম মন থেকে মুছে গিয়েছে!’
বিভূতিভূষণের এই গল্পগুলোর মধ্যে কোথাও কোনও নাটক নেই। আমরা যাকে প্লট বলে ভাবি, সেটাও নেই। একটা সুনির্দিষ্ট শেষ নেই। কোনও ক্লাইম্যাক্স নেই যে মনে হবে, এর পর ভাবনাটা অনেকক্ষণ ধরে চলছে। কোনও মোচড় নেই। সংঘাত নেই। কেবল একটা আবহ গড়ে তোলা আছে। রুশতী সেন বিভূতিভূষণের গল্পগুচ্ছের ভূমিকায় এই গল্পগুলিকে বলেছেন, ‘গল্পহীন গল্প’। বিভূতিভূষণ যখন খুশি পাঠককে কাঁদাতে পারেন, হাঁসাতে পারেন। তাহলে তিনি এই গল্পহীন গল্পগুলো কেন লিখছেন, ইংরাজিতে যাকে বলা হয় slice of life. কারণ, বিভূতিভূষণ যেটাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তা হল সাধারণত্বের উদযাপন। বাসে যেতে যেতে আমরা দেখি, রাস্তার ধারে কেউ একটা খাচ্ছে, কেউ পেপার পড়ছে। সেখানে কোনও তরঙ্গোচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু জীবন–সত্য আছে। বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, তিনি তুচ্ছতার গান গাইবেন। তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্যের মধ্যে এই সাধারণত্বের উদযাপন করে গেছেন। তার বেশ কয়েকটা কৌশল তিনি অবলম্বন করেছেন। যেমন, একটা গৌণ চরিত্র যার কথা সমগ্র কাহিনিতে এক–দু’বার উল্লেখ হয়েছে কী হয়নি, হঠাৎ করে দু–এক পাতা বা কয়েক অনুচ্ছেদের জন্য তাকে নায়ক বা নায়িকা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কোনও বা সাধারণ বা ছোট মানুষ— সে–ই বিভূতিভূষণের নায়ক বা নায়িকা। তিনি একটা কোলাজ–ধর্ম যাপন করেছেন। তাই তাঁর তাঁর গল্প–উপন্যাসে কোনও ঠাস বুনোট নেই। মনে হয় যেন ডায়েরির ছেঁড়া পাতা বইয়ে পড়ছি।
কর্মসূত্রে লেখক রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে থেকেছেন। বিভিন্ন পেশাতেও থেকেছেন। আবার বারবার ভিনরাজ্যেও যেতে হয়েছে। তা সে বিহারের ভাগলপুর হোক বা অধুনা ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা। বিচিত্র মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। ভিন্ন জীবনযাপন, ভিন্ন রুচিবোধের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। নগরজীবন যেমন দেখেছেন, তেমনই দেখেছেন পাণ্ডববর্জিত জঙ্গল জীবন। শহুরে লোকদের সঙ্গে যেমন মিশেছেন, তেমনই মিশেছেন প্রান্তিক মানুষের সঙ্গেও। তাঁরাই গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে বারবার ফিরে এসেছে। চেনা মানুষের এত বিচিত্র জীবন, কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি। সত্য কখনও কখনও কল্পনার থেকেও বিচিত্র হয়ে থাকে। তার লেখায় সেই বিস্ময় খুঁজে পাই। সারা জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা ধরা দিয়েছে নানা চরিত্রের ভিড়ে। তাই গল্পের মধ্যেই ধরা দেয় অন্য এক ভারতবর্ষ। যে ভারতবর্ষকে আমরা হয়তো সেভাবে চিনিনি।
